বাড়ি ফেরা আর হল না রাজেশের ।

বাড়ি ফেরা আর হল না রাজেশের ।

হ্যাঁ, রাজেশ এখনও বেহালা বাজায় । তবে, আনন্দে নয় । পেটের দায়ে, আর অজানা এক গুমোট ব্যাথায় ।

দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল, বুঝতেও পারল না রাজেশ । আপনমনে বাঁশি বাজাতে বাজাতে একসময় দু-চোখে তার ঘুম নেমে এল । বাড়ির লোকজন অস্থির হয়ে উঠল, কোথায় রাজেশ ? রাজেশের বাবা অখিল গিরি স্ত্রী রাণুকে অভিযোগ করে, ‘ছেলেটা দিন দিন বকে যাচ্ছে, কোথায় একটু শাসন করবে তা নয়, কেবল বুকে আগলে রাখছ ।’
রাণু তার স্বামীর কথার কোনও জবাব দেয় না, কেবল চোখের জল মোছে । তা দেখে, অখিলের রাগ আরও বাড়ে, ‘ভগবান তো কেবল ওই একটা জিনিসই দিয়েছে, কিছু বললেই চোখের জল । ধ্যাৎ।’
অগত্যা, বাড়ির কাজের লোকজন আর পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে রাজেশের খোঁজে বের হয় অখিল । মাঠে কাজ করতে যাওয়া কয়েকজনের মুখে বিকেলে মাঠের পাশে বসে রাজেশের বাঁশি বাজানোর খবর শুনতে পেয়ে আকুল হয়ে ওঠে অখিল । মনে মনে সে ভাবে, দক্ষিণের ওই মাঠে যা শিয়ালের উপদ্রব, এতক্ষণে হয়তো –
আর ভাবতে পারে না অখিল, জলদি লোকজন নিয়ে মাঠের দিকে ছোটে । সেদিন রজেশকে খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও একটা গভীর দুশ্চিন্তা এসে বাসা বাধে অখিলের মনে । সে রাণুকে ডেকে বলে, ‘আগেও বলেছি, এ ছেলেকে তুমি ঘরে বাঁধতে পারবে না রাণু ।’
স্বামীর কথায় তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাণু, একটা কথাও বলে না । সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অখিল । রাণু সেদিন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রায় সারারাত কাটিয়ে দেয় । মনে মনে ভাবে, ‘এত সোজা, মাকে ফেলে চলে যাবি ! যাস দেখি, কি করে যাস ।’
সেই থেকে চৌদ্দ বছরের রাজেশকে অগাধ মাতৃস্নেহ দিয়ে, পরম মমতার বন্ধনে বাঁধতে নিজেকে সে কেবল উজার করেই দিল না, মন্দিরে, দর্গায় ছেলের নামে কত-ই না পুজো, কতই না মানত করে চলল । কিন্তু রাজেশের আপনভোলা মনের কোনও পরিবর্তন হল না । স্কুলের যাবার পথে, কিংবা স্কুল ফেরৎ সে মাঝেমধ্যেই নিরুদ্দেশ হত । তবে তাকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হত না তাদের পরিবারের । তাকে প্রায়ই পাওয়া যেত দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা মাঠের এক কোণে কিংবা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তের বাওরের পাশে, না হলে উত্তর পাড়ার পরিত্যক্ত নির্জন ভাঙা মন্দিরের উঁচু ঢিবিতে বসে থাকা অবস্থায় ।
আসলে, পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের যেন কোনও শৃঙ্খলেই বাঁধা যায় না । জগৎ-সংসারের ধার এরা ধারে না, পারিবারিক বা সামাজিক দায়বদ্ধতা যে কি – তা ও জানে না এরা । পরিবারের আত্মজনেরা হয়তো মেনেও নেয় এগুলো, কিন্তু নিজের প্রতি উদাসীনতা মানতে পারে না তারা । বিশেষ করে এমন সন্তানের জন্যে মা-বাবার দুশ্চিন্তা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে । তারা মনে মনে ভাবে, সন্তান বুঝি তাদের বাউণ্ডুলে হয়ে যাবে । বাবার অনুশাসনে যখন কাজ না হয়, তখন মা তার পরম মমত্ব-বাঁধনে বাঁধতে চায়, ঘরমুখো করতে চায় তার আপনভোলা সন্তানকে । মা-বাঁধনে বাঁধা পড়ে অনেকেই কিন্তু রাজেশ বুঝি বাঁধা পড়তে চায় না । তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল মা রাণু ।
রাজেশের যখন একুশ বছর বয়স তখন রাণু অখিলকে বলে, ‘মেয়ে দেখ, আমি ছেলের বিয়ে দেব ।’
বেকে বসে অখিল, ‘কোনও মেয়ের সর্বনাশ করতে আমি পারব না ।’
‘এসব কি বলছ তুমি ? কি দোষ আছে আমার ছেলের ? ও একটু আপন ভোলা – এই যা । একটা মেয়ের দায়ভার যখন ওর ওপর পড়বে, তখন দেখবে আমাদের রাজু ঠিক হয়ে যাবে ।’
‘আর তা যদি না হয় ?’
‘তুমি কি সব জেনে বসে আছ ?’
রাগ বাড়ে অখিলের, ‘তা নয় তো কি ? তোমার ছেলেকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে আমার শো-রুমে নিয়ে গেলাম। ভাবলাম, ব্যবসায় ঢুকলে টাকাপয়সা ঘাটতে ঘাটতে ওর যদি কিছু চেঞ্জ হয় । তা ও তো হল না । উলটে, বাজারে কোন এক ঠগবাজ সাধু এল, তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তার ভাঙা পুরোনো বেহালাটা কিনে নিল । বংশীবাদক থেকে উনি এখন বেহালাবাদক হয়েছেন ।’
‘বললাম তো ঘরে বউ এলে, তার টানে ও ঠিক বদলে যাবে । ওর হাত দেখে জ্যোতিষী সেই কথাই বলেছে । তিন মাসের মধ্যেই আমি ছেলের বিয়ে দেব, তুমি সব ঠিকঠাক কর । আর তা নাহলে, আমিও থাকব না – এই বলে দিলাম ।’ রাণু অখিলের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে স্থান ত্যাগ করে ।
অগত্যা, দারুণ ঘটা করে বড়োলোক গিরি বাড়ির একমাত্র সন্তান রাজেশের বিয়ে হল । মেয়ে বাড়ি তেমন অবস্থাপন্ন না হলেও মেয়ে যেন রূপে লক্ষ্মী । নিন্দুকের দল অবশ্য বলল, ‘বাদরের গলায় মুক্তোর মালা ।’

দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল । রাজেশের পরিবর্তন স্বস্তির শ্বাস বয়ে আনে গিরি দম্পতির বুকে । বার-মুখী আপনভোলা রাজেশ ব্যবসায় মন দিয়েছে । স্ত্রী শীতলের প্রেম ভালোবাসায় আপ্লুত রাজেশ যেন তাকে চোখে হারায় । রাণু বৌমাকে চুল বেঁধে সাজিয়ে গুছিয়ে চুপি চুপি বলে, ‘মা, এমন করে বেঁধে রাখিস আমার রাজুকে ।’
শ্বাশুড়ি মায়ের এমন কথায়, লাজে মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে শীতলের । বৌমার লজ্জাবনত মুখটা বুকে চেপে ধরে বলে, ‘লজ্জার কি আছে মা ? আমি তাড়াতাড়ি নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে চাই ।’
সময় চলে আপন গতিতে । শীতল যেদিন তার স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে বলে, ‘আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি ।’ রাজেশ নিজেকে সামলাতে পারে না । আনন্দে সে তাকে পাঁজা কোলে ছাঁদে নিয়ে গিয়ে হাজির হয় । তারপর জ্যোৎস্নাধৌৎ আকাশের নিচে তাকে দোলনায় বসিয়ে নিজে তার পায়ের কাছে বসে বেহালায় সে সুর তুলল। শীতল অপলক চেয়ে রইল তার স্বামীর মুখের দিকে । একসময় সে ও এসে বসল রাজেশের পাশে । রাজেশ বেহালা ছেড়ে আকড়ে ধরল তাকে । বেহালার সুরে চমকে ছুটে আসা রাণু দরজার আবডাল থেকে সবই খেয়াল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে । অন্তর্যামী বুঝি অন্তরালে মুচকি হাসলেন ।
ডেলিভারির দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, শীতলের মনে কেমন যেন এক অজানা ভয় এসে বাসা বাধতে লাগল । স্বামীর বুকে মাথা রেখে সেদিন রাতে সে বলল, ‘আমি যদি আর না ফিরি ।’ রাজেশ কথা হারিয়ে ফেলে, শীতলের কথার কোনও উত্তর না করে সে তার মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল । শীতল তার স্বামীকে বিলক্ষণ চিনত । সে বলল, ‘সবে তো ন-মাস, আমি তো এমনি বললাম । আমি তোমাকে ফেলে কোথাও যাব-ই না ।’ রাজেশ শীতলের চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘তুমি না থাকলে, আমিও থাকব না ।’

এমনিতেই শ্রাবণ, তার উপর নিম্নচাপ । গত দু-দিন ধরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, আকাশ যেন নেমে এসেছে মাটির কাছাকাছি । শীতলের প্রসববেদনা শুরু হল রাত এগারোটা নাগাদ । রাণু তার স্বামী অখিলকে বলল, ‘ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল, বৌমাকে নার্সিংহোম নিতে হবে ।’
অখিল বলে, ‘কিন্তু, ডেলিভারি ডেটের তো এখনও দশ দিন বাকী ।’
রাণু বলে, ‘এরকম দশ, বারো দিন আগে পিছে হতে পারে । তুমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল।’
শীতল কেবল চারিদিক একবার ভালো করে দেখল । রাণু বলে, ‘কিছু বলবে বৌমা ? রাজুকে খুঁজছ তাই না ?’
ব্যাথার যন্ত্রণা বুকে সয়ে অস্ফুট গলায় সে বলে, ‘আর যদি দেখা না হয় ।’
বুকটা কেঁপে ওঠে রাণুর, ‘এ কী কথা বৌমা ? সব মায়েদের যে, এ ব্যাথা সইতে হয় মা । তুমি দেখবে রাজু এসে ভালো খবরই পাবে । তখন পাগলটা আনন্দে কেমন করে দেখবে ? তোমাকে কোলে তুলে হয়তো বেহালা বাজাতেই শুরু করবে ।’

হ্যাঁ, রাজেশ এখনও বেহালা বাজায় । তবে, আনন্দে নয় । পেটের দায়ে, আর অজানা এক গুমোট ব্যাথায় । যেদিন নার্সিংহোমে শীতলকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন ভোরেই কলকাতা শোরুমের জন্যে রেডিমেড পোষাকের অর্ডার করতে যায় রাজেশ । ফেরার সময় দুর্যোগে ট্রেন বাতিল হয় । পরের দিন দুপুরে যখন সে ট্রেন থেকে নলহাটি স্টেশনে নামে, তখন তার পাড়ারই হারাধনের কাছে জানতে পারে, ডেলিভারিতে বাচ্চাকে বাঁচানো গেলেও শীতলকে বাঁচানো যায়নি । বাড়ি ফেরা আর হল না রাজেশের । তার সুপ্ত আপনভোলা বাউন্ডুলে মন তাকে টেনে নিয়ে গেল নিরুদ্দেশের পথে । দীর্ঘ পঁয়ত্রিশটা বছর পর যখন তার দেখা মিলল, শীতলের কথা জানতে চাইলে সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল । জানি না, শীতলের মুখটা সে ভুলে গেছে কি না । কিন্তু আজও জ্যোৎস্না রাতে সে সারারাত ক্লান্তিহীন বেহালা বাজিয়েই চলে ।
@ কলমে – পলাশ পোদ্দার