বাংলা সাহিত্যে লেখক পলাশ পোদ্দারের প্রথম আত্মপ্রকাশ “ভারত দিশা” কাব্যগ্রন্থে । পরবর্তীতে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এলো “ভালো নেই মঙ্গলগঞ্জ”, “অতসী (এক পতিতা মেয়ের গল্প)”- এর মত কালজয়ী উপন্যাস । তার দুটি উপন্যাসেরই ঘটনাপ্রবাহ এত সাবলীল এবং মর্মস্পর্শী, লেখার বুনোন এত নিখুঁত, অটুট পাঠক কেবল বিমুগ্ধই হননি, তাঁদের কেবল মনে হয়েছে যেন ছবি পড়ছেন । “ভালো নেই মঙ্গলগঞ্জ” উপন্যাসে শুধু অসহায়ের পুঞ্জিত বেদনা আর ক্ষমতাশীলের নিদারুণ ক্রুরতার চিত্রমালা-ই অঙ্কিত হয়নি, বরঞ্চ প্রতিধ্বনিত হয়েছে গাঁয়ের মানুষদের দুঃসহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বকালের এক জেহাদ । উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠকেরা এক অজানা সকরুণ অভিমানে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন উপন্যাসেরই চরিত্র করিমচাচা, সাহারা, বর্ষা, শিবানী, সুবীরসহ মঙ্গলগঞ্জের আরও অগণিত মানুষদের সাথে । বারবার সবার মন ভারাক্রান্ত হয়েছে এই ভেবে যে, সত্যিই এই অত্যাধুনিক যুগেও ভালো নেই মঙ্গলগঞ্জ । ঠিক তেমনিই “অতসী”-এর জন্যে ধান্যকুড়িয়া, মাটিয়া, আড়বেলিয়ার মানূষদের সকরুণ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে । মুগ্ধ পাঠক তারপর পলাশ পোদ্দারকে খুঁজে পেলেন - বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের গতে বাধা জীবনে অনভ্যস্ত আঠারো জনকে নিয়ে লেখা “দেড় ডজন আঁতেলের গল্প” গল্পসমগ্রে, “প্রেমে অপ্রেমে” উপন্যাসে রূপসী নামের এক বানজারা মেয়ের অসহায় প্রেমের কান্নার মধ্যে, “খাদানের চুপকথা” উপন্যাসে খাদানের ক্ষয়িষ্ণু আদিবাসীদের মধ্যে । “পথে পরবাসে” উপন্যাসে লেখক আরও একবার চরম সত্যের মুখে দাঁড় করিয়েছেন পাঠককুলকে – পথের মানুষদের চিন্তায় বিভোর আত্মভোলা নিধি অঞ্জনার প্রেম উপেক্ষা করে সমাজসেবী তিলোত্তমার হাত ধরে কি সত্যিই পথের সন্ধান পেয়েছিল, নাকি নিজেই একদিন পথ হারিয়ে ফেলে । গাঁয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেবেলা, কর্মসূত্রে শহুরে হলেও মাটির গন্ধ গা থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলতে পারেননি বলেই হয়তো তাঁর কালিতে প্রখর সূর্যের তাপে রাজপথের দগদগে পিচের ঘামের গন্ধের সাথে সাথে মাটির সোঁদা গন্ধও অনুভব করেন পাঠক । বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর অবস্থান কোথায়, তা ভবিষ্যতে পাঠকই নির্ধারণ করবেন । তবে তাঁর মর্মস্পর্শী লেখনীর যাদুকাঠি খুঁজতে গিয়ে সমালোচকরাও বিস্মিত না হয়ে পারেন না, যখন তাঁরা খোঁজ পান, কর্মব্যস্ত জীবনের সব বাধা পেরিয়ে লেখক বেশিরভাগ সময় কাটান, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ভূমিহীন ভূমিপুত্র সাঁওতাল, আদিবাসীদের মাঝে, রেড এলাকার বাসিন্দা, রাজপথে বেড়ে ওঠা গৃহহীনের দল, বানজারা, আউল-বাউল, চা বাগানের বস্তির লোকজন, অবহেলিত হিজড়ে থেকে অসহায় নিঃস্ব মানুষজনদের মধ্যে । স্বভাবতই এসব অসহায় মানুষদের কান্না আর দীর্ঘশ্বাস বর্ণনার সাথে সাথে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের খামখেয়ালিপনা, সমাজের চরম অবহেলা আর ঔদাসীন্য, রাজনৈতিক নেতাদের ছলাকলা আর তাদের মাত্রাহীন শোষনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে তাঁর কলম । আসলে, কল্পনার মোড়কে বাস্তবতাকে মুড়ে পরিবেশন করা লেখক পলাশ পোদ্দারের না পছন্দ । আর সেজন্যেই পাঠক তাঁর রচিত উপন্যসের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়ে ঘটনার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান ।