আকাশ ভার হয়ে আছে…..

আকাশ ভার হয়ে আছে…..

আকাশ ভার হয়ে আছে । ভোর থেকেই সূর্যের দেখা নেই । উত্তরে হাওয়ার দাপট বাড়তে শুরু করেছে । শীত এসে গেছে । অথচ বৃদ্ধ কৈলাশ নাথ দত্ত পাতলা ফতুয়া গায়ে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছেন । বড়বৌমা লেখা এসে বলল, “বাবা, বেলা যে পড়ে এল, কিছু খেয়ে নিন ।“
কৈলাশ দত্ত বললেন, “রবীন ফিরেছে বৌমা ?”
লেখা বলল, “না বাবা ।“
বৃদ্ধ বললেন, “ফোনও করেনি, না ?”
লেখা মাথা নাড়ায় । কৈলাশ নাথ আপন মনে বলে ওঠেন, “তার মানে রমেশের কোনও খবর পায়নি । চাকরি থেকে ভি.আর.এস. নিয়ে চলে গেল । একটিবার আমাদের কথাও ভাবল না । আচ্ছা বৌমা, সে তো তোমার ভালো বন্ধু ছিল, তোমাকেও কিছু বলেনি ?”
লেখা অশ্রু-চোখে মাথা নাড়ে । কৈলাশ নাথ বললেন, “কাঁদছ বৌমা ? কেঁদো না । দেখ, আমি তো কাঁদছি না । যাও, গিয়ে দেখ তোমার শ্বাশুড়ীমা কি করছে ।“
লেখা বুঝতে পারে ভিতরে ভিতরে বাবা নিঃস্ব হয়ে গেলেও বাইরে তিনি তা প্রকাশ করছেন না শুধুমাত্র মায়ের কথা ভেবে । আবার শ্বাশুড়ীমার ক্ষেত্রেও তাই । মৃত্যুপথযাত্রী নিখোঁজ সন্তানের জন্যে মা-মনটা তার গুমরে গুমরে কাঁদছে কিন্তু হাহাকার করতে পারছে না শুধুমাত্র বৃদ্ধ স্বামীর অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়ে ।
লেখা যাবার জন্যে পা বাড়াতেই কৈলাশ নাথ বললেন, “বৌমা, রমেশ বোধহয় বেঁচে নেই, না ?”
চমকে ওঠে লেখা । পাদুটো তার অসাড় হয়ে আসে । সে হাহাকার করে ওঠে, “ও কথা বলেন না বাবা । ঠাকুরপোর কিচ্ছু হবে না আপনি দেখে নিয়েন ।“
আসলে রমেশ এ বাড়ির অন্যান্য সবার মত ছিল না । সে শুধু বিদ্বানই ছিলনা, বড়লোকের ছেলে হয়েও সে যেমন বিনয়ী তেমনি পরোপকারীও ছিল । গ্রামের লোক যেমন তাকে মানত ঠিক তেমনি ভালোও বাসত । দুজনে প্রায় সমবয়সী হলেও লেখাও তার ঠাকুরপোকে স্নেহ করত নিজের ভাইয়ের মতই ।
বৃদ্ধ করুণ চোখে লেখার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “তোমার কথাই সত্যি হোক মা । কিন্তু ক্যান্সার রোগী কি বাঁচে বৌমা ?”
লেখা আর সইতে পারে না । ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ।
বৃদ্ধ কৈলাশ নাথের কোটারগত চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরতে থাকে ।
রাত গভীর । শিয়াল যে এখনও রাতকে ঘুম পাড়ানোর গান শোনায় তা বাতাসপুর এলে বোঝা যায় । কয়েক পশলা বৃষ্টি শীতের দাপট বাড়িয়েছে আরও । পুরো গ্রামটাই যেন মোটা লেপের ওম গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়েছে । ঘুম নেই তিলোত্তমার চোখে । স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই মা তাকে শোনায়, “ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্যে । শুনেছিস তো দত্ত বাড়ির ছোটো ছেলে রমেশের ক্যানসার । চাকরি-বাকরি ছেড়ে সে নাকি নিরুদ্দেশ হয়েছে । সম্বন্ধটা হলে কি সর্বনাশ হত বল তো দেখি ?” মায়ের কথার কোনও প্রত্যুত্তর করেনি সে, সোজা নিজের ঘরে চলে আসে । ভারী কাঁদতে ইচ্ছে করছিল তার । কিন্তু, কাউকে সে বুঝতে দিল না তার মনের মধ্যে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে । আক্ষেপ আসলে নিজের উপর জন্মেছে তিলোত্তমার । যে মানুষটাকে প্রাণ মন উজাড় করে ভালবাসত সে, অথচ তার মনের খবরই সে যে পায়নি । দীর্ঘ একযুগের প্রেম এতটাই ঠুনকো, তা যে সে নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছে । রমেশদার সেদিনের কথাগুলো যে কতটা মিথ্যে ছিল আজ সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে । তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত বলেই সে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিল । মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিল নিজের অনিশ্চিত জীবনের সাথে তাকে জড়াবে না বলে । কেন যে সে বুঝতে পারেনি রমেশদার কথাগুলো ? সেদিনের স্মৃতি বার বার তার মনটাকে তোলপাড় করে দিতে লাগল –
“তমা বাড়ি থেকে চাপাচাপি করছে বিয়ের জন্যে”, রমেশের কথাগুলো শুনে তিলোত্তমার মুখটা দারুণ লজ্জা আনন্দের পাঁচমিশালীতে রক্তিম হয়ে উঠল । তবুও সে মজা করার ছলে বলে, “বেশ তো, মা-বাবার পছন্দের মেয়েকে নিয়ে বাধ্য ছেলে হয়ে টোপর মাথায় দিয়ে ছাদনাতলায় গিয়ে বসো ।“
মনে মনে তিলোত্তমা ভেবেছিল, তার কথায় রমেশ বেশ গোস্যাই হবে । সেই মুহূর্তে রমেশের মুখের ভাবটা কল্পনা করে মনে মনে বেশ কৌতুক অনুভব করছিল সে । আড় চোখে সে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে ।
“কি জানি হয়তো সেটাই হতে যাচ্ছে, মনের দিক থেকে কোনও তাগিদ অনুভব করতে পারছি না”, রমেশের কথাগুলো কানে পৌঁছাতেই সে শুধু মর্মাহতই হল না, বিস্মিতও হল । দারুন অভিমানে তার যুবতী হৃদয়-গুলবাগিচার সমস্ত প্রস্ফুটিত ফুলগুলি যেন চোখ বুজতে চাইল । তিলোত্তমা ভালো করে চাইতেও পারল না রমেশের মুখের দিকে ।
রমেশ তিলোত্তমার ডান হাতটা তার দু’হাতের মুঠির মধ্যে নিতেই বারবার কেঁপে কেঁপে উঠল তার হাতখানি । মনে মনে সে ভাবে, “ইস্, এত বড় কথা বলার পর বাবু এখনই বলবে, কেমন রাগিয়ে দিলাম বল ?” কিন্তু রমেশ বলল, “সরি তমা, ভালো করে ভেবে দেখ, ছোটবেলা থেকে একই গ্রামে দুজনে বড় হয়ে উঠেছি । একে অপরকে আমরা এত বেশি করে জানি যে, আমাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্বটাই থাক –
তিলোত্তমার নারী হৃদয়ের অহংকার সজোরে ধাক্কা মেরে খাড়া করে তুলল তাকে – ছি ছি, এতটাই তুচ্ছ তুমি ? কথার মারপ্যাঁচে এতটা অবজ্ঞা বোঝার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছ ? তিলোত্তমা শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “থাক, আর বলতে হবে না রমেশদা । কলকাতায় চাকরি পাবার পর এত তাড়াতাড়ি তুমি এতটা আধুনিক হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি, চলি ।”
আর দাঁড়ায়নি তিলোত্তমা । রমেশ বলে ওঠে,”তমা আমায় ভুল বুঝ না । আমি সত্যিই তোমায় ভালোবাসি,
খুব ভালোবাসি ।”
রমেশের মুখে ভালোবাসার কথা শুনতে কি ভালোই না লাগত কিন্তু সেদিন সেই কথাগুলো কানে আসতেই তার সারা দেহে যেন শত, সহস্র কীট হেঁটে বেড়াতে লাগল । কিন্তু আজ কেন যেন সেদিনের ওই কথাগুলোই শুনতে তার ভারী ইচ্ছে করছিল । মনে মনে সে ভাবতে লাগল, সেদিন যদি ওভাবে অভিমানে চলে সে না আসত, যদি রমেশদাকে মুখ ফুটে একবার সে বলত, না রমেশদা, তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারব না । ছোটবেলা থেকে একই গ্রামে দুজনে বড় হয়ে উঠেছি, একে অপরকে আমরা খুব বেশি করে জানি – ঘর বাঁধতে এটাইতো দরকার । রমেশদাকে যদি সে ছেড়ে না চলে আসত, তার সাধ্যি ছিল না তাকে অস্বীকার করার । তাহলে হয়ত রমেশদা আজ হারিয়ে যেত না । বাঁচার একটা সুপ্ত বাসনা তার মনে যদি না-ই আসত তাহলে কিছুদিন আগেও প্রশান্তদাকে দাহ করতে এসে শ্মশানে দাঁড়িয়ে সে কেন বলেছিল, ’তমা, যাবে আমার সাথে ?’ সেদিনের কথা বারবার মনে পড়ছে আর কেঁদে আকুল হচ্ছে তিলোত্তমা –
সেদিন সে বাঁওড়ের কূলে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রশান্তদার জ্বলন্ত চিতার দিকে । সে ভাবছিল, কালও প্রশান্তদা ছিল, আজ নেই । একদিন সকলেরই যাত্রা শেষ হবে এই এখানে, কারও নিস্তার নেই । “তিলোত্তমা”, রমেশের ডাকে পাশ ফিরে তাকায় সে ।
“তুমি ভালো আছ তমা ?” রমেশের কন্ঠস্বরে একটা দমকা হাওয়া যেন বুকের পাঁজরগুলোকে আলগা করে দিল তিলোত্তমার । কতদিন পর এই নামটা ধরে আবার কেউ ডাকল তাকে । ঠোঁট দুটি না জানি কেন তার কেঁপে উঠল, “হ্যাঁ । তুমি ?”
রমেশের দীর্ঘশ্বাস পড়ে, আছি, ভালো আছি । এত ভালো যে –
কথা শেষ করতে পারে না রমেশ । সেদিন অন্ধকারে রমেশের মুখটা ভালো করে দেখা না গেলেও তিলোত্তমার কেন যেন মনে হয়েছিল ভালো নেই রমেশ । তবুও যেন তার বলতে ইচ্ছে করল , “কেন, তোমার তো ভালো থাকার কথা রমেশ, সুখে থাকার কথা । তুমি তো বলেই দিয়েছ, আমাকে বিয়ে করা যায় না ।“ কিন্তু মুখে সে বলল, “কি হয়েছে রমেশদা ?”
রমেশ কোনও কথা বলল না, কিন্তু এতটাই জোরে দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার যে, নিস্তব্ধ শ্মশানভূমিও যেন সে শব্দে সচকিত হয়ে উঠল । তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিলোত্তমা বলে, “কি হল, বললে না যে ?”
রমেশ বলল, “আমার ওপর তোমার খুব রাগ তাই-না তমা ?”
তিলোত্তমার ঠোঁটে বাঁকা কান্না-হাসি, “রাগ কেন হবে রমেশদা ?”
রমেশ বলল, “আমি বোধহয়, ক্ষমার অযোগ্য, তাই না ?”
শুকনো হাসি তিলোত্তমার , “ক্ষমা ? ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন রমেশদা ?”
রমেশ তিলোত্তমার পাশে গিয়ে বসল, “তমা, আমি যে আজও তোমার জন্যে –
রমেশের কথা শেষ হতে দেয় না তিলোত্তমা, “প্লীজ রমেশদা, ওসব কথা থাক ।“
“একবার আমার কথাগুলো শোন তমা”, কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠল রমেশ ।
“কি লাভ ?”
“লাভের অঙ্ক আমিও কোনও দিন হিসেব করিনি যে ।“
“কে বললে করনি ? না করলে, নিজেকে এতটা চেঞ্জ করতে পারতে ?”
“আমি বুঝি খুব চেঞ্জড হয়ে গেছি না ?”
“হয়তো ।“
“না তমা , চেঞ্জড হইনি , শুধু ক্ষয়ে গেছি ।“
বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে ওঠে তিলোত্তমার, “কি হয়েছে রমেশদা ?”
“না, ও কিছু না ।“
“কি চাইছ তুমি, আবার কাঁদাতে ? তাইনা ?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রমেশ বলে, “ভেবেছিলাম কিছু বলব না, একদিন তুমি সবই জানতে পারবে । কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, যাওয়ার আগে –
গলা ধরে আসে রমেশের । তিলোত্তমা বলে, “যাওয়ার আগে মানে ? কোথায় যাচ্ছ তুমি ?”
“অনেক দূরে ? প্রমশন হয়েছে, তাই ট্রান্সফার ।“
এতক্ষণে রমেশ সম্পর্কে যে ভাবনার বশবর্তী হয়ে তিলোত্তমার মনটা কোমল হয়ে উঠেছিল, তা-ই যেন পরক্ষণেই ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে উঠল, “ট্রান্সফার হচ্ছ বুঝি ? প্রমোশন হয়েছে ?”
হেসে ওঠে রমেশ, “ঠিক ধরেছ, তাই ভাবলাম তোমার কাছ থেকে বিদায় নেওয়াটা জরুরি ।“
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর তিলোত্তমার, “বিদায় ! বিদায় কেন বলছ রমেশদা ?”
“ভাবছি, আর ফিরব না । ওখানেই সেটেল হয়ে যাব”, বড্ড গম্ভীর গলার স্বর রমেশের ।
“বেশ, ভালোই তো ।“
“যাবে আমার সাথে ?”
“আমি বোধহয় খুব ফেলনা, তাইনা রমেশদা ?” বিদ্রুপের হাসি তিলোত্তমার ঠোঁটে ।
“গেলে বোধহয় ভালো করতে তমা । আমি হয়তো বেঁচে যেতাম ।“
“দায়মুক্ত হতে চাইছ ?”
“তা একরকম ।“
“থাক, রমেশদা । নিজের ভার নিজেই বইতে শিখেছি এখন । সেটাও বোধহয় তোমার জন্যেই ।“
রমেশ হেসে বলে, “ধন্যবাদ দেবে না ?”
রমেশের এমন বেহায়াপনা আর সইতে পারছিল না তিলোত্তমা, “দিয়েছি বৈকি ।“
রমেশ যেন নির্লিপ্ত, “থ্যাংকস , শুনে খুশি হলাম ।“
আর ভাবতে পারে না তিলোত্তমা । সেদিন যদি রমেশকে সে আঁকড়ে ধরত, যদি বলত হ্যাঁ, যাব তোমার সাথে, কোথায় যাবে নিয়ে চল । তাহলে আজ সে হারিয়ে যেত না । অন্তত তার ভালোবাসার মানুষটা জানতে পারত, বুঝতে পারত তার মারণ রোগের সময়ও তার প্রেম তার সাথেই আছে । একরাশ কান্না এসে সজোরে ধাক্কা মারে তিলোত্তমাকে । উপুর হয়ে বালিশে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে, “রমেশদা, তুমি কোথায় ? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে ।“