বেশ কয়েক দিন ধরেই সূর্য আর মেঘবালিকার বেশ লুকোচুরি খেলা চলছে । মাঝে মধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে বটে, তবে তা একনাগাড়ে না হওয়ার কেমন যেন একটা গুমোট গরম । আজ অবশ্য কাজল কালো মেঘ পুরো আকাশটার দখল নিয়েছে । যথারীতি একটু তড়িঘড়ি করেই ছাতা সম্বল করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম । ট্রেন থেকে নেমে বাসে উঠতেই শুরু হল ঝিরঝির বৃষ্টি । অফিসে ঢোকার আগে একবার আকাশের দিকে তাকালাম, মনে হল, মেঘ অনেকটা নীচে নেমে এসেছে । শুরু হল নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টি । দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণই নেই । বাস, ট্যাক্সি চলাচল বন্ধ হবে এখনি । না, তাই বলে আপনারা ভুলেও ভাববেন না যে, কল্লোলিনী কলকাতা বর্ষামুখর দিনে ঝিমিয়ে পড়ে । রাস্তায় উপচে পড়া জল, জলের মধ্যে দিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে চলছে আরোহীসহ টানা রিক্সা, হাঁটু ভাঙা জলের মধ্য দিয়ে চলেছে অগণিত অফিস ফেরৎ লোকজন, রাস্তার আশেপাশের বস্তির কচিকাঁচারা বুক জলে সাঁতার দিচ্ছে, সমুদ্রের ঢেউ তুলে যাত্রী ঠাসা দু’একটা বাস এগিয়ে চলেছে জলের মধ্যে দিয়ে – এতসবের পরেও আপনারা কি বলতে পারবেন, কল্লোলিনী ঝিমিয়ে পড়েছে ? যাঁরা চোখের দেখা মনে উপলব্ধি করেন তাঁরা অবশ্য বলবেন, আহা, বর্ষায় তিলোত্তমা কলকাতার কি অপরূপ সৌন্দর্য । অবশ্য আমার মত বেরসিক, কাটখোট্টা নিন্দুকের সংখ্যাও নেহাত কম নেই এ শহরে । যাক, চোখের সামনে দিয়ে একটা বাস বেরিয়ে গেল, তিল ধারণের জয়গাও নেই তাতে । বুঝতে পারলাম, কপালে আজ দুর্ভোগ নাচছে । হাঁটা লাগালাম । অবশ্য ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে যে বেশ উঁচু জায়গায় খানিকটা কম জল, সেই রাস্তা ধরলাম । “বাবু, ক’টা টাকা দাও না”, কে যেন আমার পিঠের ব্যাগটা টেনে ধরল । পিছন ফিরে দেখি এক বুড়ি । একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে, “কি ব্যাপার, ব্যাগ ধরছ কেন ?”
“একসপ্তাহ হয়ে গেল, ছেলেটা কাজে যেতে পারছে না, জ্বরে পড়ে আছে । আমাকে কেউ ভিক্ষা দিতে চায় না, তাই বলছিলাম, ক’টা টাকা দেও না, ছেলেটার জন্য একটু খাবার নিয়ে আসি”, বৃদ্ধার গুছিয়ে কথা বলার ধরণ দেখে ভাবি, লোক ঠকানোর ভালো ফন্দি । তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে হাঁটা শুরু করতেই সে ফের বলল, “দাও না বাবু ক’টা টাকা ।“ মনে মনে ভাবি,সব আপদ-বালাই কি আর কোনও লোক খুঁজে পায় না ? কেন যেন মনে হল, বুড়ির গলার স্বরটায় কেমন যেন এক আর্তি । ফের দাঁড়ালাম । বললাম, “কোথায় তোমার ছেলে ?” বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে কাছেই ফ্লাইওভারের একটা পিলারের গোড়া দেখাল । পিলারের গোড়ার বেসটা বেশ উঁচু ও অনেকটা চওড়া, জল ওঠেনি । এগিয়ে দেখি, সত্যি সত্যিই একজন একুশ, বাইশের ছেলে একটা ছেঁড়া কম্বল জড়িয়ে পড়ে আছে । কি জানি কি হল আমার, ছেলেটির কপালে হাত দিয়ে দেখি, সত্যিই জ্বরে যেন পুড়ে যাচ্ছে । বললাম, “ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যাও । চারিদিকে তো এখন ডেঙ্গু হচ্ছে । বিপদে পড়বে ।“
বৃদ্ধা বলে, “হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম, ভর্তি নেয়নি ।“
“ভর্তি নেয়নি, কেন ?” অবাক হলাম ।
“আমাদের তো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড নেই । দাও না বাবু ক’টা টাকা“, বৃদ্ধার কথায় সত্যিই মায়া হল । মানিব্যাগ খুলে দেখি, বেশি টাকা নেই । আসলে, তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হবার জন্যে টাকা নিতেই ভুলে গেছি আজ । যাকগে, নিজের জন্যে শ’খানেক টাকা রেখে বাকি তিনশো বুড়ির হাতে দিয়ে বললাম, “আর কিছু জোগাড় করে ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও ।“ মুহুর্তে আমাকে আরও বেশ কয়েকজন এসে ঘিরে ধরল । এরা আবার এল কোথা থেকে ? খেয়াল করে দেখলাম ফ্লাইওভারের প্রতিটি পিলারের গোড়ায় মোটা বেসের ওপর বস্তা, কম্বল বিছানো, অনেকে সেখানে শুয়ে, বসে ঝিমাচ্ছে । এরা হয়তো ওদেরই বউ, বাচ্চা, আত্মজন । পাশ থেকে এক তরুণী বলে ওঠে,“আমার মা, বাবা, ভাই সবার কাশি-জ্বর ।“ বুঝতে পারি, মেয়েটিও সাহায্য চায় ।
আমি সেই একই কথা বললাম, “ওদের হাসপাতালে নিয়ে যাস না কেন ?”
“আমাদের হাসপাতালে ভর্তি নেয় না”, মেয়েটির অকপট উক্তি ।
ভাবছি, এ আবার কেমন বিচার ? দেশের মধ্যেই এরা বসবাস করে, এখানেই ওদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, অথচ দু’তিনটে কাগুজে কার্ড নেই বলে ওরা হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে পারে না । তবে কি এরা দেশের মধ্যেই আলাদা দেশে বসবাস করে ? একই ভারতে বহু ভারত ! অথচ, মাঝেমধ্যেই দেখি কিছু স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন এদের খাবার, কম্বল, কাপড় বিলি করে, সেলফি তোলে, আবার তা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়ও পোস্ট করে বাহবা কুড়ায় । অথচ, তাদের অধিকার নিয়ে দারুণভাবে নীরব । হঠাৎই খেয়াল করলাম, একটা ছোট্ট শিশু জলের মধ্য দিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে, মাথাটা কেবল তার জলের উপর । আমি সবকিছু ভুলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম । শিশুটি আমার সামনে এসে তার বাঁহাতখানা আমার দিকে প্রসারিত করে । বুঝতে পারি, সে ও আমার কাছে সাহায্য চাইছে ? বললাম, “খিদে পেয়েছে ?” ছোট্ট শিশু মাথা নাড়ায় ।
পাশ থেকে আগের তরুণী বলে ওঠে, “কাল ওর মা মারা গেছে ।“
“আর কেউ নেই ?” শিশুটির দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে উঠি ।
“না”, তরণীর কথায় বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা মোচড় অনুভব করি । শিশুটির দিকে এগিয়ে গেলাম, তাকে কোলে তুলে পিলারের গোড়ায় অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় বসিয়ে বলি, “খিদে পেয়েছে, খাবি ?”
শিশুটি মাথা নাড়ায় । বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে বসে খাবার জন্যে, অফিস ব্যাগে বিস্কুটের প্যাকেট রাখা-ই থাকে । আমি সেটি ব্যাগ থেকে বের করে ওর হাতে দিতেই কেমন যেন একটা প্রসন্নতা তার চোখে মুখে দেখতে পেলাম । পরক্ষণেই ভাবলাম, বিস্কুট নাহয় এখন খেল, রাতে কিংবা কাল সকালে কি খাবে বেচারা ? আমার তো আজ আর কোনও খরচ নেই । শিয়ালদাহ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে, তারপর তো ট্রেন ধরে বাড়ি । কি আর করি, একশো টাকার নোটটা তার হাতে দিয়ে বলি, “কিছু কিনে খাস ।“ শিশুটি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মাথা নাড়ে । হঠাৎই দেখি, পাশে দাঁড়ানো আরেক কিশোর শিশুটির হাত থেকে বিস্কুটের প্যাকেট আর টাকাটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে জলের মধ্যে তীব্র গতিতে ছুটে পালিয়ে গেল । শিশুটি তার ছোট্ট দু’হাত দিয়ে নীরবে চোখের জল মুছতে লাগল । আমি অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মোবাইলটা আমার বেজে উঠল । ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে আমার দুই বছরের ছেলেটার আধো আধো গলার স্বর শুনতে পেলাম, “বাপি, বিত্তি পলে, তালাতালি বালি আয় ।“
কি জানি কেন আমার গলা ধরে এসেছিল, তৎক্ষনাৎ কথা বলতে পারলাম না । অঝোর ধারায় তখনও বৃষ্টি পড়েই চলেছে ।