“আরে দাদা, সাউন্ডবক্সটা একটু আস্তে দিন না”, গেটের সামনে দাঁড়ানো অভির কথা শুনে পাশ থেকে গোকুলদা বলে ওঠে, “ধ্যাৎ, সকালবেলা এরকম সাউন্ড ভালো লাগে নাকি ?” আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি, একসাথে প্রতিদিন যাতায়াতের সুবাদে ট্রেনের একই কামরায় কয়েকজনের খন্ড খন্ড গ্রুপ তৈরি হয় । ন্যায় হোক কিংবা অন্যায়, কেউ যদি একটা কথা বলে, গ্রুপের বাকী সব তাকেই সমর্থন করে । এক্ষেত্রে তার অন্যথা হল না । গোকুলদার মতই কমলদাও বলে ওঠে, “কানের বারোটা বাজল, অফিসে গিয়ে কাজ করতে পারলে হয় ।“ কথাগুলো বেশ জোরে জোরেই হচ্ছিল । ফলে যা হবার তাই হল, ফার্স্ট কামরার সব গ্রুপের মধ্যে একটা ঐক্যবোধ জেগে উঠল । কলেজপড়ুয়া এক যুবক বলে ওঠে, “আরে, ও দাদা, কথা কানে যাচ্ছে না । সাউন্ডটা আস্তে করেন না ।“ পাশ থেকে তারই বন্ধু বলে ওঠে, “সাউন্ড আস্তে করার কি আছে ? এসব বস্তাপচা পুরোনো গান ছেড়ে কেটে পড়ুন তো ।” গান বন্ধ হল । মাইক্রোফোন হাতে লোকটি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল । আসলে, পরের স্টেশনে যে, সে নেমে যাবে, তার উপায় নেই । অতবড় যন্ত্র মাথায় করে ভিড় ঢেলে গেটের কাছে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় । লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নিবিড় বিষণ্ণতা তাকে ছেয়ে ফেলেছে । বুঝতে পারি, দিনের প্রথমেই গান করে সামান্য টাকা উপার্জনে বাধা পড়ায় সে মনক্ষুণ্ণ । কি আর করা, যথারীতি শিয়ালদহ নেমে অফিস উদ্দেশে রওনা দিলাম ।
আজ অবশ্য অফিস ছুটির অনেক আগেই বেরিয়ে পড়লাম চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের উদ্দেশে । আমার মেজোমামার গতকাল থেকে কেমো স্টার্ট হয়েছে । অবশ্য পৌঁছানোই সার হল, আজকে আর দেখা হবে না, ভিসিটিং আওয়ার শেষ । কি আর করা, আমি তো বেশ কিছু সময় হাতে নিয়েই বেরিয়ে ছিলাম । কিন্তু ওই যে, বড় ভাগ্য করে আমরা এ শহরের নাম মিছিল নগরী অর্জন করেছি । আর তার সুফল এখন হাতেনাতে পাচ্ছি । যাকগে, দেখা যখন হল না, অন্তত ডাক্তার বোসের সাথে তো কথা বলে যাই, তাহলে জানতে পারব সবকিছু । চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দারোয়ান বাধা দিল, “আরে দাদা, ভিতরে অলরেডি চার-পাঁচজন পেসেন্ট বসে আছে, তারপরে তাদের বাড়ির লোক । এবার কিন্তু ডাক্তারবাবু রেগে যাবেন ।“ আমি বললাম, “আমার পেসেন্ট নেই, জাস্ট ডাক্তারবাবুর কাছে একটা কথা জিজ্ঞেস করেই বেরিয়ে আসব ।“ ভিতরে ঢুকে দেখি, দারোয়ান মিথ্যে বলেনি । মনে মনে ভাবি, এত বড়ো ডাক্তার, তবুও চেম্বারে এত লোক অ্যালাও করছে ? আসলে, হাসপাতালে রোগীর এত চাপ – এছাড়া করার কি-ই বা আছে ? একজন রোগী দেখার পর পরের যে লোকটি ডাক্তারবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল তাকে দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম, ট্রেনের সেই লোকটা ! কি হয়েছে ওর ? নাকি ওর সাথের ছোট্ট বাচ্চাটার কিছু হয়েছে ? কিন্তু এখানে যারা আসে, তারা তো সবাই ক্যানসারের পেসেন্ট । ওদের কথা শুনতে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়ালাম –
ডাক্তারবাবু – হাসপাতালে আজই অ্যাডমিট হয়ে যাও স্বপন । তুই কেমন আছিস রাণু ?
বুঝতে পারলাম, লোকটির নাম স্বপন, বাচ্চা মেয়েটি রাণু । রাণু কথা বলে না, কেবল ঘাড় নাড়ে । স্বপন বলল, “আজই ভর্তি ?”
ডাক্তারবাবু – হ্যাঁ, আজই । সব টেস্ট হয়ে গেছে, তোমার তো আগের সপ্তাহে-ই ভর্তি হওয়ার কথা ছিল । বললে, একসপ্তাহ সময় দিন ডাক্তারবাবু ।
স্বপন – হ্যাঁ ভেবেছিলাম, একসপ্তাহে ক’টা টাকা জোগাড় করে মেয়েটাকে দেব । কিছুদিন তো চালাতে পারবে ।
ডাক্তারবাবু – মানে ? এই গলায় গান করেছ ?
স্বপন – কি করব ডাক্তারবাবু, ভিক্ষে তো করতে পারি না, তাই গান শুনিয়ে ট্রেনে লোকের কাছে হাত পাতি ।
ডাক্তারবাবু – এই একসপ্তায়, গলার কতটা ক্ষতি করেছ, সে ধারণা আছে তোমার ?
স্বপন – গলার সুর চড়াইনি ডাক্তারবাবু, সাউন্ডবক্সের সাউন্ড বাড়িয়ে গান করেছি ।
পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট রাণু বলে ওঠে, “বাবাকে আজই ভর্তি করে দেব ডাক্তারবাবু ।“
ডাক্তারবাবু – বেশ, তাই কর । আমি লিখে দিচ্ছি, এখনি ভর্তি হয়ে যাও স্বপন, এরপরে কিন্তু বেড পাবে না ।
স্বপন – ডাক্তারবাবু, গলায় ক্যানসার, সত্যি বাঁচব ? যদি না-ই বাঁচি, থাকি না ক’টা দিন বাপ-মেয়ে একসাথে ।
“যখন তুমি সব জেনেই গেছ, তাহলে আবার এলে কেন ?” ডাক্তার বোস রেগে গেলেন, না কি স্বপনের মনের জোর বাড়ালেন বোঝা গেল না । পরক্ষণেই অবশ্য তিনি বললেন, “শোন, আজ যদি ভর্তি হও, ভালো । তা না হলে, কালই বেড অন্য একজনকে দিয়ে দেব ।“
স্বপন ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল । আমিও তাদের পিছু নিলাম । দেখলাম, মেয়ের হাত ধরে স্বপন এক ফাঁকা জায়গায় এসে হাজির হল । রাণু বলে, “এখানে আবার এলে কেন বাবা ?”
“তুই তো জেমস,কুড়কুড়ে খেতে ভালোবাসিস মা, দাঁড়া নিয়ে আসি”, স্বপন এক পা বাড়াতেই ছোট্ট রাণু তার হাত ধরে বলে, “আমার ওসব কিচ্ছু লাগবে না বাবা । এ কি, তুমি কাঁদছ ?”
চোখের জল দু’হাত দিয়ে মুছতে মুছতে স্বপন বলে, “আমাকে ছাড়া একা থাকতে পারবি মা ?”
“ইস, ক’দিন পরেই তো তুমি ফিরে আসবে ।“
“আর যদি না ফিরি”, বলেই আর দাঁড়ায় না স্বপন । দ্রুত পায়ে হাসপাতালের গেটের কাছে চিপস, কুড়কুড়ে ঝোলানো দোকানের উদ্দেশে রওনা হল ।
বাবা চলে যেতেই মেয়েটি মুখে দু’হাত চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল । আমার চোখে জল আসছে কেন ? বুকের মধ্যেটা এমন করছে কেন ? হঠাৎই রাণুকে দেখলাম, চোখের জল, নাকের জল ফ্রকের নীচটা দিয়ে ভালো করে মুছছে । গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর বাবা আসছে । বুঝলাম, বাবার থেকে চোখের জল গোপন করতেই সে ভালো করে চোখ মুছে নিল । স্বপন দু’হাতে কুড়কুড়ে, চিপস, জেমস, কেক নিয়ে রাণুর কাছে হাজির হল । তা দেখে রাণু বলে, “এত্তসব ?”
স্বপন বলে, “রাতে কেকটা খেয়ে নিস, উপোস করবি না কিন্তু । আর কাল সকালে আমাদের পাড়ার মোড়ে যে কচুরির দোকান আছে, ওখান থেকে কচুরি কিনে খেয়ে নিবি । আর শোন –
“ইস, আমি যেন আর আসছি না, কাল সকালেই তো তোমার সাথে দেখা করতে আসছি“, বয়সে ছোট হলেও চোখের জল তো তা বোঝে না । তাই বাবার থেকে চোখের জল লুকাতেই অন্যদিকে মুখ ঘুরায় রাণু ।
স্বপন বুঝতে পারে, মেয়ে তার কাঁদছে । সে রাণুর দু’বাহু ধরে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে । “কাঁদছিস, তাই না মা ? তুইও জেনে গেছিস, তোর বাবা আর বাঁচবে না”, কথা তার শেষ হতে পারল না । রাণু তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । স্বপনও তার ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে সজোরে জাপটে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন নালিশ জানায়, “আমি জ্ঞানত কোনওদিন কোনও অন্যায় করিনি, আর যদি করেও থাকি, তার শাস্তি আমি তো পাচ্ছি । আমার মেয়েটা কি অন্যায় করেছে ? এক বুড়িকে ট্রেনের ধাক্কা থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওর মা নিজেই পা পিছলে পড়ে গেল । বাবা, মাকে হারিয়ে এটুকু মেয়ে কি করে বাঁচবে ?”
ছোট্ট রাণু এই বিচিত্র জগৎ-সংসারে নিজেকে এ ক’দিনে হয়তো অভিযোজিত করে নিয়েছিল । সে নিজের চোখের জল গোপন করে, তার বাবার চোখের জল মুছিয়ে বলে, “তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে বাবা ।“ তারপর সে তার বাবার হাত ধরে টান মেরে বলে, “চলো, এর পরে গেলে যদি ভর্তি না নেয় ।“
স্বপন কোনও কথা বলে না । সে উঠে দাঁড়ায় । ছোট্ট রাণু তার বাবার হাত ধরে হাসপাতালের মুল ফটক পাড় করে ভিতরে ঢুকল ।