একে প্যাচপেচে গরম, তার উপর বিদ্যুৎ বাবাজী ভেলকি দেখাচ্ছেন । ওনার বদান্যতায় ঘেমে-নেয়ে একাক্কার । সিক্সথ পিরিয়ড শুরুর ঘন্টা পড়ল । যথারীতি ক্লান্ত পায়ে টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম ফাইভের পরিবেশের ক্লাস নিতে । আর ঠিক যখনই ক্লাসে আমার প্রবেশ, বিদ্যুৎ বাবাজীর প্রস্থান । ছাত্রছাত্রীদের একটা চাপা গুঞ্জন উঠল, “উঃ, আঃ, কি গরম।“ সত্যিই গরম আমারও লাগছিল, বললাম, “থাম, থাম সকলে, এখনি কারেন্ট চলে আসবে ।“ মিনিট পাঁচেক কেটে গেল । না, তেনার দেখা নেই । ছেলেমেয়েদের হাঁসফাঁস, তাদের ক্লান্ত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আচ্ছা, এখন পড়া নয়, কি করবি বল তো ?“ ক্লাসের সবথেকে বিচ্চুটা উঠে দাঁড়াল,”ম্যাডাম, আঁকার ক্লাস ।“ “বেশ, তাই হোক, মনে যার যা আসে আঁক দেখি“, আমার অনুমতি পাওয়া মাত্রই ক্লান্ত মুখগুলো খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল । রঙ, খাতা, পেনসিল, রবারের মাঝে আমি নীরব দর্শক হয়ে বিদ্যুৎহীন ক্লাসরুমে ঘামেভেজা রুমালটিতেই ঘাম মোছার বৃথা চেষ্টা চালাতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ কাটতেই মেঘলা আকাশ ভেঙে নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি । সবকটা একসাথে চিৎকার করে ওঠে, “বৃষ্টি, বৃষ্টি ।“ আমারও খারাপ লাগছিল না । ক্রমাগত বৃষ্টির দমক বাড়তেই লাগল । খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, শ্রাবণের আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়েছে । একটা আবছা অন্ধকার ক্লাসরুমকে ছেয়ে ফেলল, আঁকায় ভাঁটা পড়ল । দস্যিটার দিকে তাকিয়ে দেখি, আঁকার পৃষ্ঠা যথারীতি ভাঁজ করে কাগজের নৌকা বানিয়ে ফেলেছে । বললাম, “এই, কি করছিস তুই ?” সে কাগজের নৌকাটা পিছনে লুকিয়ে বলে, “কিছু না ম্যাডাম ।“ সকলের উদ্দেশে বললাম, “তোরা নৌকা বানাতে পারিস ?” সমস্বরে উত্তর এলো, “হ্যাঁ ম্যাডাম ।“ “বেশ বানা”, আমার অনুমতি পাওয়া মাত্রই আঁকার পৃষ্ঠা নিমেষে নৌকায় পরিণত হতে থাকল । নিজের ছোটবেলা এদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি যেন । স্কুলের কার্নিসের গা বেয়ে জলের ধারা ঢালু রাস্তার যেদিকে নেমে আসছে, মনে মনে ভাবলাম, আমাদের নৌকা ওখানেই ভাসবে । ছুটির ঘন্টা বাজতে আর মিনিট খানেক বাকি, সবাইকে বললাম, “চল, বারান্দায় বসেই নৌকা ভাসাই ।“ যেমন বলা তেমনি কাজ, আমাকে পিছনে ফেলে সবাই বারান্দায় গিয়ে নৌকা বাইচ-এর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠল । হঠাৎই খেয়াল করলাম, থার্ড বেঞ্চের এক কোণে শাবানা বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে । কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকতেই সে আমার দিকে ভেজা চোখে তাকায় । আমি তার মাথায় হাত রেখে বলি, “কি হয়েছে তোর, কাঁদছিস কেন ?” কচি হাত দিয়ে সে কেবল চোখের জল মুছতে লাগে, কোনও কথা বলে না । আমি হেসে বলি, “ও, তুই কাগজের নৌকা বানাতে পারিস না, তাই ?” সে সজল চোখে ঘাড় নাড়ে । “দূর বোকা, এর জন্যে কাঁদছিস । দাঁড়া আমি শিখিয়ে দিচ্ছি”, বলেই তার ব্যাগ থেকে খাতা বের করতে গিয়ে দেখি, অনেকগুলো কাগজের নৌকা । আমি তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলি, “এই তো এতগুলো নৌকো ।“ শাবানা মাথা নিচু করে বলে, “আম্মা কাল বিকেলে বানিয়ে দিয়েছিল, পুকুরে ভাসাব বলে ।“
“ভাসাসনি ?”
“না ।“
“কেন ?”
“রেখে দেব ।“
“সেকি, কেন রে ?”
“আম্মা তো আর বানাবে না ।“
বুঝতে পারি, হয়তো কাজের সময় নৌকা বানানোর জন্যে বিরক্ত করায়, ওর আম্মা রেগে গিয়ে বকাঝকা করেছে । আর এতেই ছোট্ট শাবানার অভিমান হয়েছে । আমি তার কাঁধে হাত রেখে বলি, “তুই কি বোকা রে শাবানা, বাড়ি গিয়ে দেখবি আম্মার রাগ পড়ে গেছে । আবার বায়না করলে দেখবি, তোকে কোলে বসিয়ে আগের মতই নৌকা বানিয়ে দেবে । চল তো এখন, ওদের মত আমরাও নৌকা ভাসাই ।“ দরজার দিকে এক পা এগোতেই শাবানা বলে ওঠে, “আম্মা, এতক্ষণে চলে গেছে ।“
দাঁড়ালাম । সবানার দিকে তাকাতেই দেখি সে আগের মতই মাথা নিচু করে বসে । মনে হল, সে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । কাছে গিয়ে তার পাশে বসে মাথায় হাত রাখতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । কি হয়েছে ওর আম্মার ? মেয়েটা যে ভারী কষ্ট পাচ্ছে । পরম স্নেহে ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলি, “কি হয়েছে আম্মার ?”
আমার বুকে মুখ লুকিয়ে সে ফুঁপিয়ে ওঠে, “নানা এসেছে, আম্মাকে নিয়ে যাবে ।“
“ও, তুই নানার সাথে মামুবাড়ি যেতে পারছিস না বলে কাঁদছিস ? তুই কি বোকা রে শাবানা, তোর তো স্কুল আছে, স্কুলের ছুটি পড়লে যাবি । তাছাড়া, আম্মা তো ক’দিন পরেই চলে আসবে । এই নিয়ে কেউ মন খারাপ করে ?” আমার কথা শেষ হতে না হতেই শাবানা বলে ওঠে, “ আম্মি আর আসবে না, তিন তালাকের আয়াত আজ শেষ ।“
এসব কি বলছে শাবানা ! আমার মা-হৃদয় অস্থির হয়ে উঠল । তাকে আরও বুকের কাছে টেনে নিলাম । “সকালে বুকে জাপটে আম্মা কাঁদছিল, আমি বললাম, আম্মি কাঁদছ কেন ? আম্মা বলল, আমায় ভুলে যাবি না তো ?” খুদে শাবানা আর কথা বলতে পারল না ।
আমার চোখে এত জল আসছে কেন ? নিজেকে কোনভাবেই সামলাতে পারছি না যে, তবুও বললাম, “শাবানা, আম্মার সাথে একবার দেখা করবি না ?”
শাবানা মাথা নাড়ে । ধরা গলায় বললাম, “কেন রে ?”
“সকালে আব্বা জোর করে স্কুলে দিয়ে গেল, আসার সময় আম্মা খুব কাঁদছিল, তারপরে ঘরে গিয়ে দরজা দিল । এতবার ডাকলাম, সাড়া দিল না । এতক্ষণে আম্মু চলে গেছে, তাই না ম্যাডাম ?” মুখ তুলল শাবানা । উত্তরের অপেক্ষায় সজল চোখে সে আমার দিকে অপলক চেয়ে রইল । বারকয়েক আমার ঠোঁটদুটো কেঁপে কেঁপে থেমে গেল, গলা দিয়ে স্বর বের হল না । ছোট্ট দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে শাবানা বলে, “তুমি কাঁদছ ম্যাডাম ?”
কি করে বলি তাকে, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তার মতই আমার আট বছরের সাহিনকে আমিও ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম । সেদিনও আমি বাড়ি ছাড়ার আগে কত কেঁদেছিলাম একটিবার তাকে দেখব বলে, একটিবার বুকে জাপটে ধরব বলে । সেদিন আল্লার দরবারে কত মোনাজাত করেছি, “আল্লাহ্ মেহেরবান, কি এমন অপরাধ করেছি সামান্য মন-মালিন্যে তালাক মেনে নিতে হল ।“ আজ আবার বলছি, “আল্লাহ্, আমার সাহিনের মত এই ছোট্ট মেয়েটাকে কেন জানতে হচ্ছে তালাকের আয়াত ? সবাই-এর মত এই বাচ্চাটি আনন্দ করে নৌকা ভাসাতে পারছে না কেন, কেন ও কাঁদছে খোদা ?“
“ও ম্যাডাম, সবাই তো চলে গেছে । তুমি বাড়ি যাবে না ?” দেখি কখন যেন বিচ্চুটা আমার গা ঘেঁসে এসে দাঁড়িয়েছে । বললাম, “যাই বাবা ।“
বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, বৃষ্টি থেমে গেছে । কাগজের নৌকাগুলো সব এদিক ওদিক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ।