আসুন, আজ মুম্বাইয়ের…….

আসুন, আজ মুম্বাইয়ের…….

আসুন, আজ মুম্বাইয়ের কোলাবাতে বসবাসকারী এক বাঙালি পরিবারের কথা শুনাই –
রাত একটা বেজে দশ । ঘুম ভেঙ্গে যায় শ্রেয়ার । জল খেতে গিয়ে দেখল, জলের বোতলে জল নেই । অগত্যা, জল আনতে সে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল । পাশেই তার বাবার ঘর, দরজা হাঁ হাঁ করে খোলা । ঘরের মধ্যে ঢুকে সে দেখল, অ্যালবাম খুলে বাপি অপলক তার মায়ের ফটোর দিকে তাকিয়ে । শ্রেয়ার উপস্থিতি ব্রজেনবাবু টের পর্যন্ত পেল না । একবার শ্রেয়া মনে মনে ভাবে, চলে যাবে কি না ? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, আপনভোলা মানুষটা বুঝি খুব কষ্ট পাচ্ছে । সে ডাকল,“বাপি।”
মেয়ের ডাকে ব্রজেনবাবু কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল । বড্ড সরল যান্ত্রিক গলায় সে বলে, “ডাক্তারের কাছে গিয়ে যখন শুনলাম, শ্রেয়সী দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা, খুশিতে তখন তোর মায়ের এই ফটোটা তুলেছিলাম ।”
“ও, এখনও তুমি ওকে ভুলতে পারনি বাপি ?” শ্রেয়ার প্রশ্নে কেমন যেন এক বিষণ্ণ হাসি খেলে যায় ব্রজেনবাবুর ঠোঁটে । পরক্ষণেই অবশ্য তার মুখে বিরাজ করে শিশুর সরলতা, “ভুলব বললেই কি ভোলা যায় মা ? কি করে ভুলব বল তো, তার মুখটা যে, অবিকল তোর মুখে বসানো ।“
শ্রেয়ার গলার স্বর দৃঢ় হল, বাপিকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেল, “মাঝে মাঝে কি মনে হয় জান বাপি ? মনে হয়, নিজের মুখটা অ্যাসিডে পুড়িয়ে ফেলি ।“
চমকে ওঠে ব্রজেনবাবু, “এ তুই কি বলছিস মা ?” কেমন এক অসহায় চোখে সে তাকিয়ে রইল শ্রেয়ার মুখের দিকে । শ্রেয়া অবশ্য নিজেকে সামলাতে পারল না, “সত্যি বলছি বাপি, ওর কথা মনে পড়লে, নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে । দেখে নিও, আমিও হয়তো কোনদিন হারিয়ে যাব“, আর দাঁড়ায় না শ্রেয়া, পাছে বাপি তার চোখের কোনে জমে উঠতে থাকা জল দেখতে পায়, তাই সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ।
শ্রেয়া তো তার বাপির থেকে নিজের চোখের জল গোপন করতে নিজের ঘরে চলে গেল । কিন্তু পঞ্চান্ন’র এই সরলপ্রাণ, সাদা মানুষটার চোখ দিয়ে যে শ্রাবণের ধারার মত অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, তার খবর তো সে নিল না ? সামনে থাকা অ্যালবামে শ্রেয়সীর ফটোর দিকে তাকিয়ে ব্রজেনবাবু বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “মেয়েটাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি । আসলে, আজ আমার প্রিন্সিপালের প্রমোশন অর্ডার এলো তো, তাই তোমার কথা মনে পড়ল । আসলে, সেদিন আমাকে নিয়ে গর্ব করার মত তো তোমার কিছু ছিল না । কিন্তু আমার মেয়ে যে খুব কষ্ট পাচ্ছে । ওকে আশ্রয় করেই যে, বেঁচে আছি । শ্রেয়া-ই যে আমার ভুবন । না না, ওকে কষ্ট পেতে আমি দেব না“, উঠে দাঁড়ায় ব্রজেনবাবু ।
শ্রেয়া নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে কত কান্না-ই না কাঁদল । আসলে, এই বাইশের যুবতী তার বাপিকে পেয়েছে বাবা আর মায়ের মিশ্র রূপে । তার বয়স যখন চার, সবেমাত্র আধো আধো কথা বলতে শিখছে, তখন তার মা তার বাপিকে ডিভোর্সের নোটিশ ধরায় । অনামী আর্ট স্কুলের সামান্য বেতনভোগী মাষ্টার ব্রজেনকে অবশ্য শ্রেয়সী ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল । সুদর্শন যুবক ব্রজেনকে নিয়ে শ্রেয়সীর স্বপ্ন দেখা শেষ হল তখন, যখন সে বুঝতে পারে, এই আপনভোলা মানুষটি আর্টকেই কেবল ভালোবাসে – নিজের কেরিয়ার নয়, উন্নতির চরম শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা তার পক্ষে সম্ভব নয় । আর ঠিক তখনই ইউনিভার্সিটির সহপাঠী স্টেট ব্যাংকের ম্যানেজার অমিতের সাথে শ্রেয়সীর সাক্ষাৎ হয় । উচ্চবিলাসী শ্রেয়সীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হতে বেশি সময় লাগল না । ফলে, এই যান্ত্রিক যুগে যা হবার, তাই-ই হল । ব্রজেনের হাত ছেড়ে সে অমিতের হাত ধরল । সাদামাটা ব্রজেন অবশ্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিল, “শ্রেয়সী যেও না, মেয়েটা যে আমার কষ্ট পাবে । মোটে চার বছর বয়স, কি করে বাঁচাব ওকে ।“ প্রচন্ড বাস্তববাদী অত্যাধুনিকা শ্রেয়সী অবশ্য স্পষ্ট বলে, “মেয়ে কেবল আমার নয়, তোমারও । তাছাড়া, অমিত মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারবে না ।“ দরজার আবডাল থেকে অবশ্য চারের শ্রেয়া সব কিছুই শুনতে পায় । যদিও শিশুকাল, তবুও কথাগুলো এমনভাবে তার মনে দাগ কাটে যা আজও ভুলতে পারেনি । যে বয়সে শিশুর পরম আশ্রয়স্থল তার মায়ের কোল, তা হারিয়ে ফেলল ছোট্ট শ্রেয়া । আজকের মতই সেদিনও সে কেঁদেছিল – ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দরজার আবডালে মেঝেতে বসে দু’হাঁটুতে মুখ গুজে । কত কত বিনিদ্র রাত তার কেটেছে ছোটোবেলায় চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে । পাশে শুয়ে থাকা তার বাপিকে সে জানতে পর্যন্ত দেয়নি, খুব খিদে পেয়েছে তার, মায়ের কথা মনে পড়ছে ভীষণ । ওইটুকু শিশু বুঝে গেছিল, তার বাপিরও ভারী কষ্ট । সকালে উঠে রান্নাবান্না, তাকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে, কাছে ডেকে আদর করে যখন তার বাপি বলত, “মা, একা থাকতে পারবি তো ?” ছোট্ট শ্রেয়া তখন তার বাপির গলা জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ত । কিন্তু যখন তার বাপি কাজে বেরিয়ে যেত, এক অজানা ভয়ে সে কেবল চোখের জল ফেলত । তার বাপির কত শুভানুধ্যায়ী এসে তাকে কতবার বলেছে আরেকটা বিয়ে করতে । সে তখন তার ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলত, ”আমরা বাপ, বেটিতে ভালোই আছি, তাই না রে মা ?” ছোট্ট শিশু এ কথার মানে কিছুই বুঝতে পারত না, সে কেবল জানত, তার দুঃখী বাবার কথায় মাথা নাড়তে হয় । সে তার বাপির গলা জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়ত । শ্রেয়সী চলে যাবার বছর দুয়েক বাদে মুম্বাইয়েরন্যাশনাল আর্টগ্যালারিতে আর্ট প্রদর্শনীতে নানা ছবির পাশে ব্রজেনের আঁকা একটা ছবি রাখে তারই এক বন্ধু । দেশ বিদেশের নানা গুণী শিল্পীরা ভূয়সী প্রশংসা করে সেই ছবির । ব্রজেনের ভাগ্যের চাকাও সেদিন থেকে ঘুরতে শুরু করে । স্যার জে জে স্কুল অফ আর্ট এর ম্যানেজমেন্ট ডেকে পাঠায় ব্রজেনকে । তাকে কলেজের অস্থায়ী প্রফেসর হিসাবে নিয়োগ করা হয় । বছর ঘুরতে না ঘুরতে চিত্রকলা নিয়ে তার ভাবনা, গবেষণা আর অধ্যবসায় দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে স্থায়ী প্রফেসর পদে উন্নীত করে । আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় না ব্রজেনকে । পরিচিত মহলে ব্রজেনের নামের শেষে বাবু যোগ হল । আর্ট সম্পর্কিত নানা সেমিনারে দেশ, বিদেশ থেকে তার ডাক আসতে লাগল । কিন্তু যেখানেই সে যেত, শ্রেয়াকে কাছ ছাড়া করত না । তারপর কেটে গেল কত কত বছর । শ্রেয়সী শ্রেয়ার মনে মা থেকে মহিলায় পরিণত হল । শ্রেয়া মনে মনে ভাবে, একটা দিনের জন্যেও তার বাপি তাকে ওই মহিলার অভাব অনুভব করতে দেয়নি । আজ সেই লোকটাই যখন কলেজের প্রিন্সিপাল হতে চলেছে তখন হয়তোবা মনের কোনও দূর্বল জায়গা থেকে ওই মহিলার মুখটা মনে পড়ে গেছে । আর সেজন্যেই অ্যালবাম খুলে তার ছবিগুলো দেখছিল । আর এ ভাবনা তো অস্বাভাবিকও নয়, ওই মহিলা নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেলেও তার বাপি তো সেই জায়গাটা ফাঁকাই রেখেছে । এসব কথা ভাবতেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা মোচড় অনুভব করে শ্রেয়া । না না, বাপিকে এভাবে তার বলা উচিত হয়নি । তার দেওয়া আঘাত যে, সইতে পারবে না তার বাপি । চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়া । পিছন ফিরতেই দেখে ব্রজেনবাবু তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে, চোখ তার জলে ভেজা । শ্রেয়া কোনদিন তার বাপিকে কাঁদতে দেখেনি, সে সইতে পারল না, ডুকরে কেঁদে তাকে জড়িয়ে ধরল, “বাপি, তুমি কাঁদছ ?”
“তুইও তো কাঁদছিস মা”, গদগদ গলায় বলে ওঠে ব্রজেনবাবু ।
মুখ তোলে শ্রেয়া, চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, “এই দেখ আমি আর কাঁদছি না, তুমিও কাঁদবে না বাপি, কোনদিন তোমার চোখে জল দেখিনি, আমার কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে ।“
ব্রজেনবাবু হাসার চেষ্টা করল, “না রে মা, এই দেখ, আমি আর কাঁদছি না ।“
তবুও না জানি কেন, বাবা-মেয়ের চোখে বোবা জল অনর্গল ঝরতেই লাগল।