চলুন, আজ বেদিয়া বস্তি…….

চলুন, আজ বেদিয়া বস্তি…….

চলুন, আজ বেদিয়া বস্তি নিয়ে যাই আপনাদের । বনগাঁ থেকে শিয়ালদহগামী ট্রেনে দমদম ঢোকার মুখে লাইনের ডানদিকে যে বস্তিটা, তার নামই বেদিয়া বস্তি । আর এই বস্তির পশ্চিমের একেবারে শেষপ্রান্তের টালির ছাউনি, মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া ভাঙাচোরা ঘরটায় ধীমান আর তার মা থাকে । ধীমান । বস্তির যে কেউ তাকে এক ডাকে চেনে । আসলে, বছর বারোর ধীমান পড়াশোনায় যেমন মেধাবী ছিল, দস্যিপনায়ও তার সমকক্ষ কেউ ছিল না । সেদিন স্কুলে যাবার সময় বড়ো রাস্তার বাঁদিকে মোড় ঘুরতেই একটা পাকা আম তার পায়ের কাছে এসে পড়ল । দাঁড়াল ধীমান । উপরের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল, মগডালে পেকে রয়েছে অনেকগুলো আম । আসলে, অত উপরে উঠে আম পাড়ার কথা কেউ ভাবতেই পারে না । যথারীতি ধীমানকে দেখা গেল গাছের একেবারে মগডালে । “আর উঠো না, পড়ে যাবে তো”, ধীমান তাকিয়ে দেখল, পাশেই ফ্লাটের চারতলায় বক্স জানালায় বসে তার থেকে বয়সে ছোট একটি ছেলে । তার দিকে তাকাতেই সে ফের বলল, “পড়ে যাবে তো ।“ মুন্সিয়ানা হাসি ধীমানের ঠোঁটে, “কিচ্ছু হবে না, তুই আম খাবি ?” ঘাড় নাড়ে ছেলেটি । ধীমান পাকা আম সব পেড়ে তার স্কুল ব্যাগে ঢুকাল । তারপর ডাল বেয়ে জানালার পাশ দিয়ে যে মোটা ডালটা চলে গেছে সেখানে এসে হাজির হল সে । ব্যাগ থেকে দুটো আম বের করে ছেলেটিকে বলল, “এই নে ধর । তোর নাম কি ?”
“আকাশ । তোমার নাম ?”
”ধীমান । আগে, আম দুটো তো ধর ।“
আকাশ হাত বাড়িয়ে আম দুটো নিল, “তুমি স্কুলে যাচ্ছ ?”
”হ্যাঁ, তুই যাবি না ?”
”ডাক্তার আঙ্কেল বারণ করেছে । আমার তো শরীর খারাপ ।“
”কি হয়েছে তোর ?”
“জ্বর”, আকাশের কথায় হো হো করে হেসে ওঠে ধীমান, “ধ্যাৎ, আমার তো কত্ত জ্বর হয় । জ্বরে আবার কেউ স্কুল কামাই করে নাকি ?”
”বাইরে বের হতে আমারও খুব ইচ্ছে করে”, চোখের জল মোছে আকাশ । তা দেখে ধীমানের মনটা ভারী হয়ে ওঠে, “দূর বোকা কাঁদছিস কেন ? জ্বর কমলে আবার স্কুলে যাবি । আচ্ছা, তুই ঘুড়ি ওড়াতে পারিস ?”
মাথা নাড়ে ছেলটি, ”না ।“
“ঘুড়ি উড়াতে পারিস না ? আচ্ছা দাঁড়া, বিকেলে এখানেই থাকবি, স্কুল থেকে ফেরার পথে, তোকে ঘুড়ি উড়ানো শিখিয়ে দেব ।“ ধীমান আর দাঁড়ায় না, গাছ থেকে নেমে সোজা স্কুলের দিকে রওনা হল । আকাশের সাথে বেদিয়া বস্তির ধীমানের পরিচয় এভাবেই । তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই স্কুলে যাবার পথে আর বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে ধীমানকে দেখা যায় আমগাছে উঠে আকাশের পাশে । প্রায়ই সে আম, পেয়ারা, লিচু, খেঁজুর নিয়ে এসে আকাশকে দিয়ে বলত, “নে, ধর । হ্যাঁ রে, আমি যা দিই, খাস তো ? না কি ফেলে দিস ।“ আকাশ হেসে বলে, “খাই তো, খুব ভালো লাগে ?” ধীমান কেমন যেন বিজ্ঞের মত বলে, ”হ্যাঁ, খাবি । ফল খেলে শরীর ভালো থাকে । এগুলো তো একেবারে গাছ থেকে পেড়ে আনা টাটকা ফল । ক’দিন খা, দেখবি শরীর একেবারে চাঙ্গা হয়ে গেছে ।“ ঘুড়ি ওড়াতে ভীষণ ভালো লাগত আকাশের । জানালার কাছে বসে বসে আকাশের অগণিত ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে সে ভাবত, “কত্ত ঘুড়ি, যেন আকাশ ছুঁয়েছে । ইস, আমিও যদি ঘুড়ি ওড়াতে পারতাম ।“ তার এ স্বপ্ন যে, কোনওদিন সত্যি হবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি ছোট্ট আকাশ । ধীমান লাটাইটা আকাশের হাতে দিত, আর ঘুড়ির সুতো ধরে সে ঘুড়িকে পৌঁছে দিত সব ঘুড়ির উপরে । এ ক’দিনে আকাশ শিখে গেছিল, লাটাই থেকে কিভাবে সুতো ছাড়তে হয় । সেদিন বিকেলে ধীমান এসে তাকে বলে, “আজ তুই নিজেই ঘুড়ি ওড়াবি, আমি কিন্তু সুতো ধরব না ।“ আকাশ বলে, “আমি পারব ?” “আলবত পারবি, কার চেলা, দেখতে হবে না ?” ধীমানের কথা শেষ হতে না হতেই নীচ থেকে চড়া গলার আওয়াজ কানে আসে, “নাম, নাম ওখান থেকে ।“ ধীমান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “কে রে ?” আকাশ বলে, “শক্তিদা, আমাদের ফ্ল্যাটের গার্ড, তুমি পালাও ।“ ধীমানের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি, “পালাবো ? কেন রে ? আমি চোর নাকি ?” অতঃপর ধীমান গাছ থেকে নেমে শক্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শক্তি তার হাতটা ধরে বলে, ”বাড়ি কোথায় ?”
“এই তো, পাশের বেদিয়া বস্তি”, ধীমানের কথায় পাশে দাঁড়ানো পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রমহিলা আঁতকে ওঠে, “ও মাই গড । ভাগ্যিস দেখতে পেয়েছিলাম, ওই বস্তিতে তো সব অ্যান্টিসোশ্যাল, আর পাতাখোরদের বাস ।“
ধীমানের আঁতে ঘা লাগে, “একদম বাজে কথা বলবেন না ।“ শক্তি ধমক দেয়, “এই চোপ, জানালার কাছে কি করিছিলি তাই বল ?” “আকাশকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখাচ্ছিলাম“, ধীমানের কথায় ভদ্রমহিলা শক্তির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “দেখলি তো, বাচ্চাটাকে ফুসলিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার প্ল্যান । আরে, এর সাথে অনেকে যুক্ত আছে । ওকে ধরে রাখ, আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি ।“ পুলিশের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় ধীমান । সে গায়ের সব শক্তি একত্রিত করে জোরে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালিয়ে গেল । তারপর থেকে ধীমানকে আর ও রাস্তায় দেখা যায়নি । সে স্কুলে যেত অনেকটা ঘুরে অন্য পথে । যদিও আকাশের মুখটা ভুলতে তার অনেকদিন সময় লেগেছিল । পথচলতি কোনও আম, লিচু, পেয়ারা, খেঁজুর গাছ দেখে যখন সে দাঁড়িয়ে পড়ত ফল পাড়ার জন্যে, তখনই আকাশের মুখটা ভেসে উঠত তার চোখের সামনে । ফল পাড়া আর হত না । ঘুড়ি উড়ানোও সে ছেড়েছিল একই কারণে ।
দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে গেল । সময়ের আবর্তনে ধীরে ধীরে আকাশের মুখটা তার স্মৃতিতে ধুসর হয়ে এলো । ছুটির পর স্কুলের গেট থেকে সামান্য এগোতেই সামনে শক্তিকে দাঁড়ানো দেখেই একটা ভয় এসে তাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল । তাহলে কি পুলিশ নিয়ে এসেছে সে ? কিছু ভেবে ওঠার আগেই শক্তি এসে তার ডানহাতটা সজোরে ধরে ফেলে । “আমি কি করেছি ? ওদিকে তো আর আমি যাই-ই না”, ধীমানের কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশের এক ভদ্রমহিলা বলে ওঠে, “আমার সাথে একবার যাবে ধীমান, আমাদের বাড়ী ?” ধীমান তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, দেবীমায়ের মত এমন সুন্দর মুখ সে কোনওদিন দেখেনি । ভদ্রমহিলা ফের বলে, “আমি আকাশের মা ।“ একরাশ অভিমান এসে ঘিরে ধরে ধীমানকে । আপনমনে সে বলে ওঠে, “না, আমি যাব না । সেদিন যখন সবাই আমাকে চোর বলল, ও কেবল শুনল, একটা কথাও বলল না । আমি ওকে কত ভালো বাসতাম, আর ও কিনা ”, আর বলতে পারে না ধীমান, গলা ধরে আসে, কেবল চোখ মুছতে লাগল ।
“আমার আকাশও যে তোমাকে খুব ভালোবাসে বাবা”, আকাশের মায়ের কথায় কান্না গলায় ধীমান বলে ওঠে, “মোটেও না ।“
“এক সপ্তাহ হয়ে গেল, বেহুশ হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা । কেবল বিড়বিড় করে চলেছে, ধীমান, ধীমানদা, আমার ঘুড়ি যে আর ওড়ে না । তুমি কোথায় ? কখনও বলছে, আমার খুব খিদে পেয়েছে, দাও না পেয়ারাটা”, ওড়না দিয়ে চোখের জল মোছে আকাশের মা ।
“বেহুশ হয়ে পড়ে আছে ? কেন ? জ্বর কমেনি এখনও ?” কেমন যেন উতলা হয়ে ওঠে ধীমান ।
“না বাবা, আজ সকালে ডাক্তার বলে গেছে, আর বড় জোর দশ দিন”, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আকাশের মা কণিকা মিত্র । “দশদিন ! ডাক্তার বলে দিয়েছে !” যান্ত্রিক গলায় বলে ওঠে ধীমান ।
”একমাস আগেই নার্সিং হোম থেকে ছেড়ে দিয়েছিল, ডাক্তাররা বলল, আর তো কটা দিন, আপনার কাছে নিয়েই রাখুন । এবার বুঝি ও সত্যি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ”, কন্ঠ রোধ হয়ে আসে কণিকার । ধীমান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তার মুখের দিকে, “চলে যাবে ?“
“হ্যাঁ বাবা, ওর যে থ্যালাসেমিয়া । লাস্ট স্টেজ“, কণিকার কথা শুনে ধীমান ফের আপনমনে বলে চলে, “চলে যাবে, বললেই হল । কত রক্ত লাগবে ওর, আমি বস্তির সবাইকে নিয়ে হাজির হব । আমারই তো ও-নেগেটিভ, এরকম কত্ত আছে । দরকার হলে সব রক্ত দিয়ে দেব । দাঁড়া যাওয়াচ্ছি তোকে”, বলেই সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল । পিছন থেকে কণিকা কত ডাকল, সে থামল না ।
ধীমান ছুটতে ছুটতে সেই বুড়ো আমগাছটার নীচে এসে দাঁড়াল । তারপর উঠে গেল মগডালে একেবারে আকাশের ঘরের জানালার কাছে । জানালা বন্ধ । ধীমান ডাকে, “আকাশ, এই আকাশ ।“ কোনও সাড়া নেই । গলাটা নিজেরও কেমন ধরা ধরা বোধ হল । গলা পরিষ্কার করে ফের সে বলতে শুরু করে, “আকাশ, এই আকাশ, জানালাটা খোল না ভাই । দেখ, দেখ না, আকাশে কত্ত ঘুড়ি উড়ছে, আমরাও ঘুড়ি উড়াবো । তোর কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করে না তো, বেশ খেতে হবে না বাড়ির খাবার, আমি এত্ত এত্ত পেয়ারা, লিচু, খেজুর নিয়ে আসব । কই রে, খোল না জানালাটা ।“
এতক্ষণে, কণিকাও চলে এসেছে । “ধীমান গাছ থেকে নেমে আয় বাবা, ও উঠতে পারবে না রে, আমার সাথে ঘরে চল বাবা“, কণিকার কথায় ধীমান বলে ওঠে, “কক্ষনো না, উঠতে পারবে না বললেই হল । কিচ্ছু হয়নি ওর । ও যদি জানালা না খোলে, আমিও যাব না । আকাশ, এই আকাশ, খোল না জানালা। বেশ, খুলবি না তো, আমিও চললাম। আর কোনওদিন এ মুখো হব না, এই বলে রাখলাম ।“ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর, চোখের জল মুছতে মুছতে ধীমান নীচে নামার জন্যে এক পা বাড়াতেই জানালায় খট করে আওয়াজ হল । সেদিকে তাকিয়ে ধীমান দেখল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশ তার দিকে অপলক চেয়ে । দু’চোখে তার শ্রাবণের ধারা অনর্গল পড়ছে । ডুকরে ওঠে ধীমান, “একদম কাঁদবি না। তুই কাঁদলে আমারও খুব কষ্ট হয় । চিন্তা কি, আমি তো এসে গেছি । কিচ্ছু হবে না তোর ।“
আকাশ হাত বাড়ায় । ধীমান তার হাতটা ধরতে তার আরও কাছে এগিয়ে যায় । নিজের বুকের কাছে হাতটা রেখে সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমার পরমায়ু আকাশকে দাও ভগবান ।“
জানি না, বস্তির ছেলে ধীমানের সেই কথা অনিতা শুনতে পেল কি না ।