মেঘ মনে হচ্ছে অনেকটা…..

মেঘ মনে হচ্ছে অনেকটা…..

মেঘ মনে হচ্ছে অনেকটা নিচে নেমে এসেছে । বৃষ্টি আসবে এখনই । বস্ত্রদান ও খাবার বিতরণ পর্ব শেষ হতেই তিলোত্তমার তাড়াহুড়ো দেখে মাস্টারমশাই বললেন, ‘মা, এমন কেন কইরছ ? মোরা তো আছেক বটে ।’
‘দাই, আইজ ত্যুকে ছাড়বেক লাই বটে’, অজয় বলল।
তিলোত্তমা বলে, ‘অজয়, একথা কেন বলছ ভাই ? আমি কি এখানে থাকিনি কোনদিন ? আসলে, অনেকটা দূর ফিরতে হবে তো, বাড়িতে মা একা । তাছাড়া আরও এক জায়গায় যেতে হবে, ক’দিন পরেই তো আবার আসছি ।’
হঠাৎই একদল মানুষকে লাঠি, বল্লম, তির-ধনুক নিয়ে তাদের পাশ দিয়ে পুবদিকে ছুটতে দেখে তিলোত্তমা মাস্টারমশায়ের দিকে তাকাল । পরক্ষণেই সে আরও আশ্চর্য হল যখন সে দেখল, মাঠের অপরপ্রান্ত থেকে হৈ হৈ করতে করতে আরেকদল তির ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে । প্রথম দলটি থমকে দাঁড়াল । তারাও অপর দলকে লক্ষ্য করে তির ছুড়তে লাগল ।
মাস্টারমশাই বললেন, ‘মা, ইখানে দাঁড়ানো ঠিক লয় ।’
অবাক কন্ঠস্বর তিলোত্তমার , ‘স্যার, এসব কি হচ্ছে ?’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘সব খতম হইয়া যাইবেক মা । সান্তার জাতির মইধ্যে বিভেদ তৈয়ার হইছেক বটে ।’
হঠাৎই একটা তির সাঁ সাঁ করে তিলোত্তমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল । তিলোত্তমা দুই কানে হাত দিয়ে ‘মাগো’ বলে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল । নিধি ছুটে এল তিলোত্তমার কাছে । পরক্ষণেই আরেকটা তির ছুটে বেরিয়ে গেল নিধির বুকের পাশ ঘেঁষে । ‘মা‘, ছোট্ট শিশুর আর্তনাদে পিছন ফিরে সকলে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল । সবার হাত পা অসাড় হয়ে এল । বছর চার, পাঁচের ছেলেটি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে, পিঠে তার তির বেঁধা । নিধি ছুটে গিয়ে দাঁড়াল বাচ্চা ছেলেটির পাশে । চোখে তার জল ছলছল করছে । ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে উন্মত্ত আদিবাসীদের দিকে তাকাল একবার । এবার দু’চোখে যেন তার আগুন ঝরছে । নিধি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়েই দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলল লড়াইয়ে সামিল দু’দলের মাঝখানে । তিলোত্তমা এগিয়ে গিয়ে নিধির পথ আগলায়, ‘নিধিদা কোথায় যাচ্ছ ?’
তিলোত্তমার কোনও কথা-ই কানে গেল না নিধির । সে তাকে বাঁ হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে এগিয়ে গেল । তিরবিদ্ধ বাচ্চাকে কোলে তুলে ভৈরব রূপের এক অপরিচিতকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে নিজেদের মধ্যে তির ছোঁড়ার মারণ প্রতিযোগিতা ভুলে গেল দু’দলের মানুষজন । বাচ্চাটিকে ধরে থাকা দুইহাত প্রসারিত করে নিধি গর্জন করে ওঠে, ‘কে তির মেরেছে ? কে মেরেছে, হিম্মত থাকে তো সামনে আয় । মরণ খেলার এত শখ তোদের ? মর না সবাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে । কিন্তু, এ বাচ্চার কি দোষ ?’ নিধি থামল । তার মুখ রাগে থমথমে । চোখ দুটি যেন দগদগে লাল সূর্যের সব তাপ শুষে নিয়েছে এবং তা এখনি ঠিকরে বেরিয়ে সবাইকে পুড়িয়ে যেন খাক করে দেবে । তিলোত্তমা ভয় পেয়ে পাশ থেকে ডাকল,‘ নিধিদা ‘ ।
নিধি তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘চোপ । তুমি এদের উপকার করতে এসেছ ? এদের ? যারা নিজেদের ভালো বোঝে না । যাদের নিজের স্বধর্মের উপর মায়া, মমতা নেই । নিজের জাতিকে যারা রক্ষা করতে চায় না । তাদের ? এদের অস্তিত্ব না থাকাই ভালো । থামলি কেন ? চালা তির । একে অপরকে মেরে ধ্বংস হ । মর শালারা ।’ হঠাৎই বাচ্চাটির গোঙানি চঞ্চল করে তোলে নিধিকে । সে তাকে বুকের আরও কাছে জাপটে ধরে বলে ওঠে,‘ভয় নেই, ডরিস না । কিছু হবে না তোর ।’ নিধি তাকে নিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে সামনের দিকে । অজয় এসে বলল, ‘বাবু, উকে লিয়ে উদিকে চল না কেনে । ওঝার নিকট চল কেনে ।’ অজয় একপ্রকার দৌড়াতে লাগল ওঝার বাড়ির দিকে । নিধি ছুটতে লাগল তার পিছু পিছু । স্কুল ছাড়িয়ে বাঁদিকের গলি দিয়ে এগিয়ে খানিকটা যেতেই একটা ভাঙা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল অজয় । ‘ই পবন খুড়া, আরায় আছেক কেনে ?’ অজয়ের ডাকে এক বুড়ো বাইরে বেরিয়ে এল । অজয় বলল, ‘খুড়া এইকটিবার দেখ কেনে ম্যুদের শিবুর ফলা বিঁধছেক বটে ।’
পবন ওঝা নিধিকে লক্ষ্য করে বলে, ‘উহাকে দাওয়ায় লিয়ে আয় কেনে ।’
নিধি ছোট্ট শিবুকে কোলের উপর শুইয়ে দাওয়ায় গিয়ে বসল । পবন ওঝা ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগল শিবুকে । কখনও তিরবেঁধা জায়গাটা, কখনও শিবুর নাকের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে লাগল সে । অবশেষে শিবুর পিঠে অনেকক্ষণ কান পেতে পড়ে রইল এ অঞ্চলের অভিজ্ঞ বৃদ্ধ ওঝা পবন মুর্মু । পাশ থেকে অজয় ডাকল, ‘খুড়া ।’
পবন ওঝা মাথা তুলল, ‘ও আর জীবিত লাই বটে ।’
একটা অজানা অসহায় আর্তনাদ করে ওঠে নিধি । শরীরে যেন কোনও বল নেই, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার, অসহনীয় যন্ত্রণায় মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠল । একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট শিশু শিবুর মুখের দিকে । নিধির দিকে তাকিয়ে বুকটা ধড়াস করে ওঠে তিলোত্তমার । পবন ওঝার বাড়ি তখন লোকে লোকারণ্য । আসলে ছোট্ট শিবুর মা বাবা ছিল না । বছর দুয়েক বয়সের সময় তার মা, বাবা কলেরায় মারা যায় । সেই থেকে শিবু এ বাড়ি, ও বাড়িতে পাত পেতে মানুষ । তার চেহারা , তার কথাবার্তা এমন মধুর ছিল সবাই তাকে ভীষণ ভালবাসত । তাছাড়া ছোট্ট হলে কি হবে, তার সামর্থ্য অনুযায়ী সে সকলের কাজ করে দিত । শিবুর মৃত্যু যেন কোনও মতেই মেনে নিতে পারছে না এ গাঁয়ের লোকজন । সমবেত লোকজনের দিকে নিধি একবার তাকাল । তারপর নিথর শিবুকে কোল থেকে নামিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে ধীর পায়ে সে এগিয়ে চলে স্কুল মাঠের দিকে ।
তিলোত্তমা পাশে দাঁড়ান মাস্টারমশাইকে বলল, ‘মাস্টারমশাই, এটা রাখুন ।’
মাস্টারমশাই দেখলেন, শিবুকে দেওয়া নতুন জামা প্যান্ট । তিলোত্তমা বলে,‘তিরের ঘায়ে ও যেখানে পড়ে গেছিল এগুলো সেখানেই ছিল । নতুন জামা প্যান্ট পেয়ে আনন্দে ছোটাছুটি করছিল ছেলেটা ।’ গলা ধরে আসে তিলোত্তমার । খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলে, ‘ওকে কবর দেওয়ার আগে এগুলো ওকে পরিয়ে দিয়েন ।’ আর দাঁড়ায় না তিলোত্তমা, চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় সে । মাস্টারমশাই তিলোত্তমাকে বাঁধা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করলেন না । তিনি উঁচু স্বরে বললেন, ‘আমাদের সাহায্য কইরতে আর ইখানে আইস না মা । মরা মানুষদের কি কেউ জীবিত কইরতে পারে ? সান্তাররা যে ইখ্খন সব জ্যান্ত মরা মানুষ ।’
নিজের জাতির উপর অভিমানে দগ্ধ মাস্টারমশাই যে কথা বললেন, এইমুহূর্তে দাঁড়িয়ে তা অস্বীকারের জায়গা বোধহয় নেই । যে নীতিই হোক না কেন, তা রাজনীতিই হোক, কিংবা অর্থনীতি ; ধর্মনীতি কিংবা শিক্ষানীতি তাতে যদি বৈষম্য ঢুকে পড়ে তাহলে তার প্রভাব কখনই একটা জাতির উত্তরণ ঘটাতে পারে না । বরঞ্চ, সেই বৈষম্য থেকে ধীরে ধীরে যে অবিশ্বাস, অনৈক্য তৈরি হয়, তা শুধু একটি জাতিকেই নয়, গোটা দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে । জন্মলগ্ন থেকে ঐক্যবদ্ধ সাঁওতালদের মধ্যে ধীরে ধীরে এই যে অনৈক্য তৈরি হয়েছে এবং তা ঠিক পঞ্চায়েত ভোটের আগে, এর জন্যে দায়ী যে কোন নীতি, তা যদি এখনই এই জাতি বুঝতে না পারে, তাহলে এদের সমূহ বিপদ । জানি না, জীবন দিয়ে ছোট্ট শিবু সেই সত্যটা এদের বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারল কিনা ?