টুসুর বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম I ঝন্টুর মৃত্যুতে নির্বাক টুসুকে প্রায় উলঙ্গ করে টকটকে লাল কাপড় পড়া কয়েকজন ঘিরে আছে I ঝাঁটা দিয়ে একজন তাকে মেরেই চলেছে I অপর কয়েকজন ধুনুচিতে নারকেল ছোবড়া আর ধুনা দিয়ে আগুন ধরিয়ে রাশি রাশি ধোঁয়া সৃষ্টি করে নেচেই চলেছে I টুসু টলছে, এখনই সে যেন মূর্ছা যাবে I দৌড়ে গিয়ে ধরলাম তাকে, ‘টুসু, এই টুসু I’
কেমন যেন করুণ চোখে তাকিয়ে রইল সে আমার দিকে I লাল পোশাকের একজন রাক্ষুসে দৃষ্টি নিয়ে তাকাল আমার দিকে, ‘ত্যু ?’
ধমক দিলাম তাকে, ‘চোপ, কি হচ্ছে এসব ? মেয়েটি যে মারা যাবে I’
প্রথমে লোকটি কেমন যেন হকচকিয়ে গেল I কিন্তু, পরক্ষণেই সে স্বমূর্তি ধরল, ‘ই, ত্যু ইঞকে ম্যাঃ রাঙাইছিস ? ইত্ত সাহোস ত্যুহার ! কোন আছিস ত্যু ?’
অপর লোকগুলোও ঘিরে ধরল আমায় I চোখ রক্ত জবার মত লাল I দাসরথী ছুটে এল আমার পাশে, ‘দাদা, চল এখান থেকে I’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘এমনিতেই ঝন্টু খুন হবার পর টুসুর যা অবস্থা, তার উপর এমন ঝাড়পোঁচ হলে, এ তো মারা যাবে I টুসুকে নিয়ে এখনি ডাক্তারের কাছে চল দাসরথী I’
এক ঝাঁক ক্ষুধার্ত ধূর্ত হায়নাদের মুখ থেকে শিকার পালিয়ে যাবার উপক্রম করলে তারা যেমন হিংস্র হয়ে ঘিরে ধরে তাকে, ঠিক তেমনি টুসুকে ঘিরে ধরে গুনিনরা I দলের পাণ্ডা হুঙ্কার ছাড়ে, ‘ইত্ত সাহোস ত্যুহাদের ? ই খাঁড়ায় কি দেইখছিস বটে I লিয়ে আয় উহাকে I জিন ক্ষ্যেইপলে সক্কলের মইরতে হইবে I পুরা তল্লাটে কেহ বাঁইচবেক লাই I’
আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল ওরা I টুসুর চুলের মুঠি ধরে নিয়ে গেল দলের পাণ্ডার কাছে I তারপর তাকে ছুড়ে ফেলল তার পায়ের কাছে I নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছিল আমার I দাসরথী আমাকে টেনে তুলল, ‘দাদা, চল এখান থেকে I’
‘এ যে অন্যায় ! না না , এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না’, কথা শেষ করতে না করতেই দেখি ঝিনুক, রাজু, আরও কয়েকজন এসে দাঁড়াল আমার কাছে I মনে কিছুটা সাহস পেলাম I প্রধান পাণ্ডার কিন্তু এসবে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই I মাটিতে পড়ে থাকা টুসুর সারা গায়ে ধুনুচির ছাই ছড়াতে লাগল সে I টুসুর মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন মনে হতে লাগল, মেয়েটি বোধহয় অর্ধমৃত হয়ে গেছে – এই দানবদের পাল্লায় পড়ে I শয়তানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ‘এই কি হচ্ছে, বন্ধ কর এসব I’
পাশে রাখা ত্রিশূল নিয়ে লোকটি আমার দিকে তেড়ে এল, ‘ইক্কেবারে খতম কইরা দিবেক ত্যুহাকে I’
রাজু এসে তার ত্রিশূলটা ধরতেই অন্যান্য চেলাগুলোও ত্রিশূল উঁচু করে ছুটে এল I অবাক হয়ে দেখছি আশেপাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে লাখনামারা গাঁয়ের মানুষ I যারা মস্টার বলে এত সম্মান, এত খাতির করে, তাদের এমনভাবে মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ আমি খুঁজে পেলাম না I ঝিনুক সামনে এসে দাঁড়াল,‘রাজু, ছাড়, ছাড় ওর ত্রিশূল I’ রাজু বেঁকে দাঁড়াল, ‘দাই, ত্যু কি ভাইবছিস বটে I একবার বোল না কেনে, সক্কলকে এইকসাথ শ্যাস কইরা দিবেক I’ পাশে দাঁড়ানো কালীপদ লাঠি নিয়ে রাজুর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ই, একদম জিবেত গোর দিবেক, হট শুকরির গিদ্রারা I’
ঝিনুক কালীপদকে ধমক দিল, ‘একদম বাজে কথা বলবি না কালীপদ I যা সবাই, যা এখান থেকে I’ তবুও তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝিনুক দাসরথীকে বলল, ‘দাশরথ, কি হল ? বললাম না, সবাইকে নিয়ে যা এখান থেকে I’
দাসরথী বলল, ‘ কিন্তু দাদা ?’
‘দাদার কথা ভাবতে হবে না, তোরা তো যা ’, কেমন যেন বিরক্তি ঝরে পড়ল ঝিনুকের গলায় I
দাসরথী সবাইকে বলল,’ রাজু, কালীপদ চল সক্কলে I’
টুসুর প্রতিবেশিনী একজন আমার সামনে এসে বলল, ’মস্টার, ত্যুহার সক্কল বুলি আলে মানাও করেক বটে I মেনখন, ইনিক টুসুকে জিউ ধইরছে I’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বৃদ্ধা এসে বলল, ‘হ মস্টার, ঝুন্টুর জিউ I’
পাশের আরেকজন এসে বলল, ‘উ জিউ টুসুকে লিয়ে যাবেক বটে, উহার সঙ্গে I’
অবাক হয়ে দেখলাম, সবাই একযোগে বলে উঠল , ‘সত্য বুলি বটে I’
এদের এই ভুল ধারণা, এমন কুসংস্কার থেকে টেনে বের করে আনা দরকার I চোয়াল আমার শক্ত হয়ে উঠল, বলতে গেলাম, কিন্তু তার আগে ঝিনুক বলে উঠল, ‘ঠিক আছে I আসলে জিউ, জিন এসব ভুতপ্রেত সম্পর্কে মাস্টার জানে না তো I চলুন মাস্টার I’
ঝিনুকের কথায় আমি অবাক হলাম । আদিবাসী হলেও ঝিনুক তো উচ্চশিক্ষিত, কুসংস্কার মুক্ত । তাহলে, এসব কি বলছে ঝিনুক ? আমি বললাম, ‘এসব কি হচ্ছে ঝিনুক ?’
আমার কথা যেন ঝিনুকের কানেই গেল না, ‘চলুন মাস্টার’, বলেই সে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই আমি বলে উঠলাম, ‘দাঁড়াও ঝিনুক I’
ঝিনুক ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি কি চাও, সবার সামনে তোমার হাত ধরে টানাটানি করি ? চল আর দাঁড়িয়ো না I’
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি ঝিনুকের পিছু নিলাম I পাণ্ডা গুনিন বলে উঠল, ‘ শুন্ সক্কলে, ই জিন খুউব কুটেট পানজার আছেক I ইখ্খনে হবেক লাই I উহাকে ইনিক ডেরায় লিয়ে যা I দরবাজা বন্ধ কইরা উহার যজ্ঞ কইরতে হইবে I না হইলে, ঝন্টুর হড়মো ছাইরবার সোময় লাহারে যাহাকে পাইবে উহাকে শ্যাষ কইরা দিবেক বটে I’
ঝিনুককে বললাম, ‘শুনলে শয়তানটার কথা I ডেরায় নিয়ে গিয়ে যজ্ঞ করার নামে ঘরের দরজা বন্ধ করে ওরা ছিঁড়ে খাবে টুসুকে I’
‘জানি’, ঝিনুকের স্বাভাবিক কন্ঠস্বরে অবাক না হয়ে পারলাম না, ‘কি ? সব জেনেও এভাবে চুপচাপ চলে যাব ?’ ঝিনুককে নিশ্চুপ দেখে কিছুদূর চলে এসেও দাঁড়িয়ে পড়লাম I দেখলাম, আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়েছে দাসরথীরাও I
ঝিনুক বলল, ‘কি হল ?’
‘সব জেনেও, ওদের ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে ? ঠিক আছে তুমি যাও, আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব’, বলেই টুসুদের বাড়ির দিকে এক পা এগোতেই ঝিনুক আমার হাত ধরে বলে, ‘তাপস, প্লিজ I’
দাঁড়ালাম আমি I ঝিনুক আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ ওদের ভয় নয়, ভয় তোমাকে নিয়ে I’
মানে ?
যারা তোমাকে মাস্টার বলে মাথায় করে রেখেছে I এ কাজে বাধা দিতে গেলে, তারাই তোমাকে এ ঘটনার পর গ্রাম থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লাগবে I
নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, ‘কখন-ই না I ওদের এ অন্ধবিশ্বাস মন থেকে তাড়াতেই হবে I’
‘কিছু কিছু অন্ধবিশ্বাস, আমাদের সাঁওতালদের মনে এমন জায়গা করে নিয়েছে যে, তা এত সহজে যাবার নয় I এর জন্যে আরও সময় দরকার তাপস I আরও, আরও বেশি করে আমাদের সবার সাথে তোমাকে মিশতে হবে, ধীরে ধীরে একটু একটু করে বোঝাতে হবে I এত সহজে এ যাবার নয় I’ ধীর শান্ত গলায় কথাগুলো বলল ঝিনুক I
মনে মনে ভাবছি ঝিনুকই হয়ত ঠিক I অসহায়ের মত একবার তাকালাম টুসুদের বাড়ির দিকে I দেখলাম, এক ষণ্ডামার্কা ভণ্ড টুসুকে কাঁধে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে ওদের ডেরায় I এক অসহায় যুবতীর দেহ ভোগ করার দারুণ প্রাকউন্মাদনায় মেতে উঠেছে তারা I মহোল্লাসে টুসুর পিছু নিয়েছে অন্যান্য গুনিনরা I ভাবতেও যেন অবাক লাগছে, এই অত্যাধুনিক যুগেও কত সহজে ভণ্ড বাবা অথবা গুনিনদের খপ্পরে পড়ে নিজের বাড়ির মেয়েকেই এরা তুলে দিচ্ছে ওদের হাতে ধর্ষিত হবার জন্যে I এই প্রথম মনে হয়, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, ‘হা ভগবান I’