তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা…..

তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা…..

‘দরজাটা খোল’, মায়ের গলার স্বর।
তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলতেই মা ভিতরে ঢুকে বললেন, ‘তোর আলো জ্বালানো দেখেই বুঝলাম, তুই উঠে গেছিস। প্রশান্ত রাত দুটো নাগাদ মারা গেছে।’
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তিলোত্তমা তার মায়ের মুখের দিকে। মুখ দিয়ে কথা সরে না তার। মা ফের বললেন, ‘দত্ত বাড়ির মেজো ছেলে ফোন করে জানিয়েছে ওদের।’
আপনমনে বিড়বিড় করে ওঠে তিলোত্তমা, ‘ডাক্তার যে বললেন, কোনও বিপদ নেই।’
কথাটা মায়ের কানে গেল। তিনি বললেন, ‘সে কথা তো সবাই বলছে। দত্ত বাড়ির মেজো ছেলেও বলছিল, ট্রিটমেন্টে নিশ্চয় কোনও গাফিলতি হয়েছে, নইলে জ্ঞান ফেরার পর এমন হওয়ার কথা নয়। ‘
‘তুমি গেছিলে ও বাড়ি?’ তিলোত্তমার প্রশ্নে মা বলেন, ‘খবর পেয়ে দত্তবাড়ির ছোটো ছেলে প্রথমে তোর কাছেই এসেছিল।’
‘আমায় ডাকলে না কেন ?’ তিলোত্তমা বলল।
পুষ্পদেবী বললেন, ‘সারাদিন নাওয়া-খাওয়া না করে অত রাতে বাড়ি ফিরলি, তাই তোকে আর ডাকিনি। আমিই গেলাম ওদের বাড়ি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিলোত্তমা, ‘ও ।’
তিলোত্তমাকে উঠতে দেখে মা বললেন, ‘উঠছিস যে!’
আপনমনে সে বলে, ‘ যাই একটু ঘুরে আসি। টাকা পয়সাও তো ওদের কাছে নেই। ডেড বডি তো আনতে হবে।’
পুষ্পদেবী বললেন, ‘রমেশ মনে হয় এতক্ষণে ম্যাটাডোর নিয়ে রওনা হয়ে গেছে।’
তিলোত্তমা আর কোনও কথা বলে না। টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাস থেকে এক ঢোক জল খেয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মা বললেন, ‘ভোর হতে এখনও বেশ দেরি। আলোটা নিভিয়ে চোখদুটো একটু বুজে থাক মা। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে – এগুলোতে মানুষের হাত নেই মা।’
এ কথার কোনও জবাব দেয় না তিলোত্তমা। মা পুষ্পদেবী ঘর থেকে যাবার আগে শুধু বললেন, ‘নে, আলোটা নিভিয়ে দে মা।’
তিলোত্তমা লাইটের সুইচ অফ করল বটে কিন্তু ফের গিয়ে দাঁড়াল জানালার পাশে। রক্তের কোনও সম্পর্ক না থাকলেও প্রশান্ত ছিল তিলোত্তমার খুব কাছের মানুষ। যখন যে কাজের জন্য ডাকা হত, সে না করত না। অবশ্য বিনিময়ে তার জন্য সে পারিশ্রমিক পেত। কিন্তু টাকা নিতে কেমন ইতস্ততঃ করত সে, ‘না, না, এই কামটার জইন্যে টাকা লইতে পারুম না দিদি। নিজের গাঁটের কড়ি খরচ কইরা গরীব দুঃখীর সেবা কইরছ, আর সেই মাল বইবার জইন্যে ম্যুই টাকা লইলে ভগবান পাপ দিবে না?’ কিন্তু তিলোত্তমা জানত, প্রশান্ত দিনমজুর। একদিন পারিশ্রমিক না পেলে ভাঁড়ারে তার টান পড়বে। সেজন্যে রোজের টাকা সে জোরজবরদস্তি তার পকেটে গুঁজে দিত। কিন্তু আজ থেকে শত চেষ্টা করলেও তাকে যে আর পাওয়া যাবে না। কালও যে ছিল, আজ সে নেই – একটা শূন্যতায় হৃদয়টা কেমন যেন গুমরে গুমরে উঠতে লাগল। ( “পথে পরবাসে” – দীপ প্রকাশন )
আমাদের আশেপাশেই প্রশান্ত’র মতো অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যারা প্রভাব প্রতিপত্তিতে অতি নগণ্য হলেও মানবিকতার বিচারে অনেক উর্দ্ধে। আশেপাশের মানুষদের সাহায্য করতে এরা তৎপর। কখনও কোনও বৃদ্ধ বাবা মার ওষুধ কিনে দেওয়া, বাজার করে দেওয়া, গৃহস্থালীর কাজ করে দেওয়া তাদের সন্তানদের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে, কখনও নিজের সামান্য দৈনিক রোজগার থেকে আরও দরিদ্র কোনও মানুষের উপকার করা। দিন হোক অথবা রাত, এদের যেকোনও সময় ডাকলেই খুঁজে পাওয়া যায়। তথাকথিত মুখোশধারী ভদ্রলোকের সমাজে এরাই হল আসল ভদ্রলোক, আসল মানুষ। অথচ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের করুণ পরিণতি হতে দেখা যায়। মনে রাখবেন, প্রশান্ত’র মতো এই খেটে খাওয়া, হাতে পায়ে ধুলো মেখে শ্রম দান করে যাওয়া মেহনতী মানুষগুলোই সভ্যতার চালক, ধারক এবং বাহক।