কবিতা, গল্প, উপন্যাসের মতো পত্র লেখাও সাহিত্যের আঙিনায় পড়ে । তাই পত্রও সাহিত্য। যদিও বা আজ পত্র সাহিত্য লুপ্তপ্রায় তবুও বলতে হয় যে, চাক্ষুসে উপস্থিত না থাকা ব্যক্তির সঙ্গে এটাই ছিল একসময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। দূরে অবস্থানরত প্রিয়জনের চিঠির অপেক্ষায় থাকতেন মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তানেরা কিংবা আত্মপরিজন, বন্ধুবান্ধব। এই চিঠিগুলো পাবার পর উচ্ছ্বাসের সীমা থাকত না । সযত্নে এই চিঠিগুলো তারা রেখে দিত বছরের পর বছর কখনো-কখনো আমৃত্যুকাল অবধি।কত হাসি, কত সুখ, দুঃখ, কান্না লুকিয়ে থাকত এই চিঠিগুলোর মধ্যে। চিঠিগুলোকে পর পর প্রকাশ করলে সেই ব্যক্তির গোটা জীবন, তার চরিত্র, সুখ দুঃখের অনুভূতিগুলো ফুটে উঠত। বহু সাহিত্যিকদের রচিত ব্যক্তিগত পত্রাবলীও সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ, দার্শনিক ও সাহিত্যিক জীবনধারার পরিচয় তাঁর লেখা পত্রসাহিত্য ‘ছিন্নপত্র’-এ ফুটে উঠেছে। পত্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পত্রাবলী উল্লেখযোগ্য। এমনকি সেই রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকে এই পত্র রচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং, পত্র রচনার এই ধারাবাহিকতা বহুদিনের। শুধু কী উপন্যাসে, কাব্য রচনার ক্ষেত্রেও পত্রের ব্যবহার দারুণ জনপ্রিয়।মধুসূদন দত্তের লেখা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যটি পত্র কাব্য হিসাবে ক্লাসিকের মর্যাদা নিয়েছে। নবীনচন্দ্র সেনের ‘প্রবাসের পত্র ‘, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ বিলাতের পত্র ‘ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে আমাদের চারপাশ। মানুষ এখন আর চিঠি লেখে না, বা লিখতে ইচ্ছুক নয়। যে চিঠি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকত আজ সেই চিঠি লেখার ভাষা বা ধরণটুকু তারা জানে না। কারণ, কাগজ আর কলমের জায়গা নিয়েছে মুঠোফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ। মানুষ এখন ভার্চুয়াল হয়ে উঠেছে। প্রিয়জনের সঙ্গে খবর আদান প্রদান হয় এখন মুহূর্তের মধ্যে। তাই চিঠি লেখা সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয় এই প্রজন্মের কাছে। তাই চিঠি লিখতে গিয়ে যে মানুষের লেখার হাত গড়ে উঠত ভাষা সুন্দর ও সাবলীল হত বানান শুদ্ধিকরণ হতো আজ আর তা দেখতে পাওয়া যায় না। পাতার পর পাতা লেখা চিঠি আজ এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকটা লাইনে, আস্ত একটা বানানকে নিজেদের সুবিধামত ভেঙেচুরে এমন একটা জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যে, আসল তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের আবেগের মতো আজ পত্রসাহিত্য লুপ্ত হতে বসেছে। আধুনিকতার মানে পুরাতন সব কিছু ধুয়েমুছে ফেলা নয়, বরং পুরাতনকে সাথে করে নিয়ে নতুনের সাথে এগিয়ে চলা। তাই এই আশা রাখি যে, পত্রসাহিত্য তার হারানো স্থান ও মর্যাদা আবার ফিরে পাবে এবং নিজেকে স্ব আসনে অধিষ্ঠিত করবে।