‘দাদাবাবু আসো, কখন থেকে তোমার পথ চেয়ে বসে আছি, বলি আজ এত দেরি হল কেন? আমি তো ভাবলাম আজ আর বুঝি আসবে না ‘ কমল হাসতে হাসতে বলল আমাকে।
‘আর বলিস না, শেষ সময়ে একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং পড়ে গেল, তাই আজ দেরি হয়ে গেল অফিস থেকে বেরোতে। দে দে, আমার মুড়িটা দে।’
‘কেন গো দাদা আজ এখানে বসে খাবে না?’
‘না রে, আজ না, এমনি দেরি হয়ে গেছে। তোর বৌদি এবার রেগে আগুন হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা যাও। কাল এসো, কাল তো তোমার ছুটি। ‘
হুম আসব, কদিন কাজের চাপে আর আড্ডা দিতে আসা হচ্ছে না। কাল নিশ্চয়ই আসব।’ এই বলে আমি হনহনিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর যাবৎ আমার এই একই রুটিন। এক আধ দিন ছাড়া এর অন্যথা হয় না। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে কমলের দোকানে বসে মুড়ি, চপ, চা খেয়ে তবে বাড়ি ফেরা আর বাড়িতেও নিয়ে আসা। সেখানে বসে কত আড্ডাই না হয় আমাদের বন্ধুদের। কমলও আজ আমাদেরই একজন হয়ে গেছে। বয়সও আমার কাছাকাছি হবে। আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। আমি সবে সবে চাকরি পেয়েছি। যাতায়াতের পথে দেখতাম কমল কেমন দিশেহারা। ওদের দোকানের খদ্দেরও ক্রমশ কমে আসছে। একদিন জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার রে, কতদিন দেখি নি, দোকানও বন্ধ ছিল, আর তোর এরকম উদভ্রান্তের মতো অবস্থা কেন?’
কমল বলল, “মাস দুয়েক আগে বাবা দেশে গেছিলো, হঠাৎই অসুস্থ হয়ে সেখানেই মারা যায়। বাবা বাজারে বেশ কিছু দেনা করে রেখেছে। এখন সেগুলো মেটাতেই নাজেহাল অবস্থা আমার। দোকান বিক্রি করে দিতে হবে মনে হচ্ছে গো দাদা। ‘
কমলের এই কথা আমাকে ব্যথিত করে তুলেছিল। কমলের বাবার সঙ্গে আমার বাবার কত বন্ধুত্ব দেখেছি ছেলেবেলা থেকে। তাই বাবাকে গিয়ে বললাম,’বাবা তুমি ওদের সাহায্য কর।’
তারপর থেকে আজ ত্রিশ বছর কেটে গেছে। কমলের দোকান আজ রমরমিয়ে চলে। ওর দোকানের মুড়ি নিতে দূর দূর থেকে লোক আসে। ওর পরিবার এই মুড়ি তৈরির কাজ নিজেরাই করে মান ধরে রাখার জন্য। সাথে দোকানে রয়েছে হরেক রকমের চপ। আর পাওয়া যায় চা, ঘুগনি। দামও সে সকলের সাধ্যের মধ্যেই রাখে। আর তার সাথে ওর অমায়িক ব্যবহার, অন্যের সাথে একাত্ম হওয়ার সহমর্মিতা। কালের নিয়মে এভাবেই মনে হয় কিছু সম্পর্ক অঙ্কুরিত হয়, বেড়ে ওঠে যত্নে-আদরে, বিস্তার করে শাখা-প্রশাখা । শুধুমাত্র হৃদয়ের টানে, প্রতিদিনের আলাপচারিতায়, কেউ কেউ যেন খুব কাছের হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন পরিবেশের মানুষরা যেন মনের খুব কাছে থাকা প্রতিবেশী হয়ে ওঠে । জীবনের নদীপথে চলতে চলতে যখন ক্লান্ত শরীর শ্রান্ত মন কুলের কিনারা খোঁজে, তখন এই মানুষ গুলো হাত বাড়িয়ে দেয়, বলে আমরা আছি আমরা থাকবো।