ভূগোলের মাস্টার সত্যসাধন দাস…..

ভূগোলের মাস্টার সত্যসাধন দাস…..

ভূগোলের মাস্টার সত্যসাধন দাস ক্লাসে ঢুকেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন, ফার্স্ট বেঞ্চের একেবারে বাঁ – দিকের কোণায় শুভময় বসে। বার কয়েক তিনি তার দিকে আড় চোখে তাকালেন, রোল কলের সময়। শেষ রোল ‘ফিফটি সেভেন’ কল করেও কেউ যখন ‘ ইয়েস স্যার ‘ বলে উঠে দাঁড়াল না, তখন তিনি আবার ‘ফিফটি সেভেন’ কল করলেন, এবারও কেউ উঠে দাঁড়াল না দেখে তিনি শুভময়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘কীরে নিজের রোলটাও কি ভুলে গেলি?’
উঠে দাঁড়িয়ে শুভময় উত্তর করল, ‘না স্যার, ছ -বছর ধরে তো ওই একই রোল নম্বর।’
রেগে গেলেন ভূগোল স্যার, ‘তাহলে সাড়া দিলি নে কেন?’
– আপনি তো আমায় দেখেছেন। দশবার।
-মানে?
-আমি শুনেছি, ক্লাসে ঢুকে আপনি আমার দিকে দশ বার তাকিয়েছেন স্যার।
-তাতে কী হয়েছে?
– আপনি যখন দেখেই নিয়েছেন, আমি ক্লাসেই আছি, তাই আর ‘ প্রেজেন্ট স্যার’ বললাম না।
– বাঃ, কী বুদ্ধিরে তোর, তা এই বুদ্ধিটা একটু পড়াশুনার ব্যাপারে খরচ কর, তাহলে হয়ত রোল নম্বর একটু এগোয়, বুঝলি গাধা?
ক্লাসরুমে হাসির একটা চাপা আওয়াজ উঠতেই ভূগোল স্যার ডাস্টার দিয়ে টেবিলের ওপর কয়েক ঘা মেরে বলে উঠলেন, ‘স্টপ, স্টপ ‘।
সবাই চুপ করলে তিনি বললেন, ‘কাল তোদের ক্যাটাবেটিক বায়ুপ্রবাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়।’
প্রায় সবাই-ই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ স্যার।’
স্যার এবার শুভময়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ক্যাটাবেটিক বায়ু সম্পর্কে টীকা এবার মাধ্যমিকে বেশ ইমপর্টেন্ট, বুঝতে পেরেছিস তুই?’
-হ্যাঁ স্যার?
-বলত দেখি।
শুভময় মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘স্যার, ক্যাট মানে তো বিড়াল; আর বেট কথাটি এসেছে ব্যাট থেকে; মানে বিড়ালকে ব্যাট দিয়ে পেটালে বেড়াল যেরকম কান্না করে ঠিক তেমনই, এমন এমন বায়ু আছে যা জোরে প্রবাহিত হলে ওরকম শব্দ উৎপন্ন হয়, এককথায় আমরা তাদের ক্যাটাবেটিক বায়ু বলে থাকি।’
সত্যসাধন বাবু কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন শুভময়ের দিকে। তার এমন অবাক করা বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে শুভময় বলে উঠলো, ‘ছবি এঁকে দেখাবো স্যার।’
কেমন যেন উদাস কণ্ঠস্বর সত্যসাধনবাবুর, ‘ছবি, ছবি – আঁকবি?’
উৎসাহে টইটম্বুর শুভময় বলল, ‘হ্যাঁ স্যার।’
-কী ছবি আঁকবি শুভ?
-ওই যে বিড়ালকে কেউ ব্যাট দিয়ে পেটাচ্ছে। ছবি আঁকলে টীকাতে ফুল মার্কস স্যার।
(দেড় ডজন আঁতেলের গল্প)
কী সুন্দরই না দিনগুলো ছিল। জীবনের গোল্ডেন ইয়ার্স। আনন্দ-হাসি-মজা ভরা ছিল স্কুলের দিনগুলো। চিন্তা অবশ্য যা ছিল তা ছিল পরীক্ষার চিন্তা। ওই জিনিসটি বড়ো বিরক্তিকর বস্তু ছিল ছাত্রদের কাছে। তবে শুভময়ের মতো অনেক বন্ধু ছিল আমাদের ক্লাসে যারা কোনো চাপ নিতো না কোনো বিষয়ে। দুর্বার প্রাণশক্তিতে ভরা এরকম ছাত্র যেমন ছিল তেমনই নিরীহ ভালোমানুষ, পড়াকু ছাত্রও ছিল। আর ছিল শিক্ষক মশাইদের শাসন, বকুনি, আর হুম কিছু কিছু সময় পিটুনিও। আড্ডা মারা, ক্লাসে শিক্ষক থাকাকালীন টিফিন খাওয়া, বেঞ্চ পিটিয়ে গানের মজলিস বসানো, ইচ্ছা করে কোনো শিক্ষকের নকল করা, কোনো বন্ধুকে ক্লাসের বাইরে বের করে দেওয়া হলে নিজেরাও ইচ্ছে করে কোনো দোষ না করে বন্ধুকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে যাওয়া, এসব স্মৃতি ভোলার নয়। এগুলো ছিল বেঁচে থাকার অক্সিজেন। আজ যখন অতীতে তাকাই এই স্কুল জীবনটাকেই সবচেয়ে বেশি মনে পরে। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত, আনন্দ উচ্ছল ছাত্রজীবন।