“আর কতদিন সাইকেলটাকে এভাবে ফেলে রাখবে, বেচে দিলেও তো পারো, ক’টা টাকা পাবে”, বেশ ঝাঁঝাল গলার স্বর গিন্নির ।
রাগের কারণ, আমার সাইকেল, যার বয়স আনুমানিক চল্লিশ বছর এবং অকেজো হয়ে পড়ে আছে প্রায় এক যুগ । তাই এই নিয়ে মাঝে মাঝে গিন্নি ক্ষেপে ওঠে চরমে । তার বক্তব্য অতি সোজাসাপটা – হয় ব্যবহার করো, নয় তো বেচে দাও । ভুল কিছু বলে না । অযথা সিঁড়ির নিচের জায়গাটা দখল করে রেখেছে । সজীব মানুষেরই আজ কোনও দাম নেই, এটা তো একটা জড় পদার্থ । নিজেও ভেবেছি অনেকবার, বেচে দেব, কিন্তু পারি না। গিন্নিকে কি করে বোঝাবো এ কথা – সাইকেলটার সাথে যে, আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
১০ বছরের জন্মদিনে ঠাকুমা এই সাইকেলটা আমায় কিনে দিয়েছিল। সাইকেল পাবার যে কি আনন্দ সেদিন আমার হয়েছিল সেটা আজও আমার স্মৃতিতে অমলিন। ঠাকুমার এই স্মৃতিকে ফেলে দিতে কিছুতেই মন চায় না আমার । বাবাকে দেখেছি ঠাকুরদা, ঠাকুমার মৃত্যুর পরেও তাদের সব পুরোনো জিনিসকে আগলে রাখতে । বাবাকে যখন সেগুলো কাউকে দিয়ে দিতে, বা বেচতে, নতুবা ফেলে দিতে বলতাম তখন সে বলতো, এখন বুঝবি না খোকা । সত্যি, তখন বুঝিনি, বুঝি এখন । ছেলেকে অবশ্য বলেছিলাম, সাইকেলটা ব্যবহার করতে । কিন্তু নতুন যুগের নতুন পছন্দ । এরকম পুরোনো জিনিস তার পছন্দ হবে কেন ? তাছাড়া, কেবল ঠাকমার স্মৃতিই হাতড়ানো নয়, এর সাথে আরও কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার । নতুন সাইকেল পেয়ে চারিদিকে অহেতুক চরকিবাজি কাটা, বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়ানো, এরই কারণে বাবার কানমলা, তাছাড়া প্রথম প্রেমে পড়ার সময়ও তো কত সঙ্গ দিয়েছে আমার এই সাইকেল। কিশোরী প্রেমিকাকে এক পলক দেখার আশায় কতবার ঘোরাঘুরি করতাম এই সাইকেল নিয়ে। কত কাদা-মাটির রাস্তা, আম,জাম,বটগাছের ছায়ায় সাইকেল দাঁড় করিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া, কত দগদগে দুপুর, কত বৃষ্টিভেজা সন্ধের স্মৃতি গায়ে জড়িয়ে রেখেছে আমার ওই পুরোনো বন্ধু বাহনটি ।
তাই, গিন্নির চোখে নেহাত একটি মরচে পড়া জং ধরে যাওয়া হ্যান্ডেল ভাঙা একটা নির্জীব বস্তু হলেও বুড়ো সাইকেলটা আজও আমার মনে পুরোনো স্মৃতির অনুরণন তোলে । সে অসাড়, অচল হলেও আমার হৃদয় আঙিনায় প্রাণবন্ততায় চঞ্চল । সে কথা বলে, ডাকে, অতীতের সাথে আমার টানকে দৃঢ় করে, বলতে চায়, কিছুই হারিয়ে যায়নি !