জিতেন মুর্মুর চারচালা বাড়ির…..

জিতেন মুর্মুর চারচালা বাড়ির…..

জিতেন মুর্মুর চারচালা বাড়ির চারদিকেই বারান্দা। পূবদিকের বারান্দায় আমার খাবার ব্যবস্থা হল। মেঝেতে একটিমাত্র আসন পাতা দেখে জিতেনকাকুকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘কি হল, আপনি খাবেন না?’
জিতেনকাকু হেসে বললেন, ‘ত্যু খা না কেনে।’
বড়ো একটা কাঁসার থালায় মোটা চালের ভাত উঁচু করে ঢিবি করা, পাশেই বেগুন ভাঁজা, বেশ বড়ো মাপের দু’টি কাঁসার বাঁটির একটিতে মুসুরডাল, অন্যটিতে মুরগীর মাংস, আরেকটি ছোট্ট বাটিতে টমেটোর চাটনি। ভাতের বহর, ডাল আর মাংসের পরিমাণ দেখে পিলে চমকাবারই কথা। আমাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে জিতেনকাকু বলে উঠলেন, ‘লে, খা লে কেনে বাবু। ম্যুদের মইতো রেঙ্গেঃ –
গলার স্বরটা না জানি কেন গম্ভীর হয়ে এল,’আমার বোধহয় আর এখানে থাকা হবে না জিতেনকাকু।’
জিতেনকাকু অবাক হয়ে বললেন, ‘কেনে বাবু, কি ত্রুটি হইলো বটে বোল না কেনে?’
গলার স্বর খাটো না করে বললাম, ‘আপনি রেঙ্গেঃ ? মানে, গরীব আছেন । আমি থাকলে তো আপনাদের আরও কষ্ট হবে। চিন্তা করেন না জিতেনকাকু, আজ বিকেলেই আমি চলে যাব।’
আমার কথায় সত্যি তিনি কষ্ট পেলেন না। হাত জোড় করে বললেন, ‘বাবু, ই কথা বইলছিস কেনে বটে ? ত্যু পেরা হোর। ম্যুইগো দেবতা বটেক।’
আদিবাসী সমাজের মানুষজনদের সংস্পর্শে যতবার এসেছি, প্রতিবারই আমি খেয়াল করেছি অতিথি তাদের কাছে সত্যিই দেবতা। ‘অতিথি নারায়ণ’ শব্দ দুটি অত্যাধুনিকতার চাকায় পিষ্ট হয়ে হয়ে আমাদের শহুরে বাবুদের কাছে তা হারিয়ে গেছে। অথচ শুকা মাটির কোলে লালিত এইসব দুঃখী মানুষগুলো অনাহারে থেকেও অপরিচিত অতিথির পেট ভরাতে সদা সচেষ্ট। যদিও কুসুমজালি গ্রামের যেটুকু ইতিমধ্যে ঘুরে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, এ গ্রামে জিতেনকাকু মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন। যাই হোক, আড় চোখে জিতেনকাকুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘থাকতে পারি, যদি আপনি আমার সাথে খেতে বসেন।’
জিতেনকাকুর চোখ দুটি আনন্দে চিক চিক করে উঠল। তিনি হয়ত খাবার থালা আনতেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু, খাবার থালা হাতে এক বৃদ্ধা সেখানে উপস্থিত হলেন, ‘লে, বাবুর মান রাইখ বটে ।’
জিতেনকাকু খাবার থালা নিয়ে আমার অনতিদূরে বসলেন। বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘একটা খালি থালা, আর দু’টো খালি বাটি দিন না আমায় ।’
আমার কথা শুনে বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ধীর পায়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি একটি থালা, আর দু’টি বাটি এনে আমার পাশে রাখলেন। অর্ধেকের বেশি ভাত অন্য থালায় তুলতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘কী কইরছিস বাবু ? উই কয়ডা মান্ডি খাইবেক ? লাহিঃ ভইরবেক ?’
শূন্য বাটিদু’টিতে মাংস আর ডাল তুলতে তুলতে বললাম, ‘শহুরে মানুষগুলোর মনের সাথে সাথে যে পেট ও ছোটো হয়ে গেছে ।’
জিতেনকাকু আমার এ কথার কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না। খাওয়া প্রায় শেষের মুখে । হঠাৎই তিনি বললেন, ‘বাবু কত্ত সমায় হোয়ে গেল বটেক। মেনখান, তুহার নাম শোনা হয় লাই বটে। হলা বইললি, খাদান দেইখতে আইসছিস?’
হেসে বললাম, ‘কেন? আপনার সন্দেহ হচ্ছে?’
জিতেনকাকু জিভ কাটলেন, ‘ই কোথা কেনে বইলছিস বাবু । থাইক ত্যুকে বইলতে হবেক লাই।’
পঞ্চাশোর্ধ জিতেন মুর্মুর মুখে কিশোরের সরলতা দেখে হাসি চাপতে পারলাম না, ‘আচ্ছা বলছি, বাড়ি কলকাতার সল্টলেক, বাবা তন্ময় রায়, বেশ নামকরা ব্যবসায়ী; আমি বেকার, বাউন্ডুলে; এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই, বাবার পয়সা ধ্বংস করি।’
জিতেন মুর্মু শান্ত গলায় বললেন, ‘অলঃপড়হা ?’
শব্দটি কানের মধ্যে ঝনঝন করে উঠল। জিতেন মুর্মু জানতে চাইছে, আমি কতদূর পড়াশুনো করেছি? যান্ত্রিক গলায় বললাম, ‘টুয়েলভ পাস করার পর আর পড়িনি।’
তিনি শুধু বললেন, ‘বাপের কামকাইজ দেখ্খা শুনা কইরছিস বটে বাবু ।’
জিতেন মুর্মুর আতিথেয়তা, তার রুচিবোধের যেটুকু পরিচয় আমি পেয়েছি, তাতে তাঁকে না বলে পারলাম না, ‘কাকু, এখন থেকে আপনি আর আমায় বাবু টাবু বলবেন না। তাপস বলেই ডাকবেন।’ (খাদানের চুপকথা)
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা আজও শোষিত, নিপীড়িত, অবহেলিত । কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত । যেখানে আমরা শহুরেরা প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও অতৃপ্ত, সেখানে এই মানুষগুলো কত অল্পতেই সন্তুষ্ট । শহুরে আদবকায়দা শিখেছি বটে, শিক্ষা, ব্যক্তিত্বে, রুচির বড়াই-ও করি, কিন্তু আসলে মানুষ হিসাবে আমরা কতটা পরিণত, আদৌ তা হতে পেরেছি কি, এদের মাঝে এসে দাঁড়ালে নিজেকে প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয় । তথাকথিত ভদ্রসমাজ থেকে শত যোজন দূরে থেকেও, পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও এই আদিবাসী মানুষরা জানে প্রকৃত শিক্ষা কী, মানবিক মূল্যবোধ কী, অথিতি সৎকার কী । মানবিকতায় পরিপূর্ণ এই মানুষগুলোর বাহ্যিক চাকচিক্য, বাবুয়ানা হয়তো নেই বটে, কিন্তু আছে সরলতা, স্নিগ্ধতা, মানবিকতা – যার মূল্য এই জগত সংসারে অনেক বেশি।