কেমন যেন উদাস গলার স্বর খুড়োর, ‘নদীতে না ভাইসলে খাবার জুইটবে কেমনে?’
এ কথার কোনও জবাব জানা নেই রহমতের। সে চুপ করে গেল। সত্যিইতো পেট বড় বালাই। তাদের মত দিনমজুর জেলেদের শরীর, মন -এসব সামান্য রোজগারে যেন কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তাহলে যে গোটা পরিবার উপোস যাবে।
কেমন যেন একটা নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধতা এসে ঘিরে ধরল রহমত, হরি, বিপিন খুড়োকে। বৈঠার টানে নদীর জলের সেই পরিচিত ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে ভেসে চলে ওরা। একসময় ওদের তিনটে নৌকোই মাঝ নদীতে একজায়গায় এসে হাজির হয়। খুড়ো বলে, ‘আইজ আর জয়লে মন নাই রহমত।’
রহমত বলে, ‘ কি আর করবা খুড়ো, সবই নিয়তি। জলেই বড় হইছি, একদিন দেখবা জলেই শ্যাষ হয়ে গেছি।’
হরি বলল, ‘এটা তুমি ঠিক কথাই বলেছ রহমতচাচা। মনে হয়না কোনোদিন আমরা ডাঙার সাধ পাব।’
‘এ কি কথা কও হরি। তোমার এখন কচি বয়াস, চেষ্টা কইরলে কিনা হয় বাপ’, খুড়ো ভরসা দেয় হরিকে।
হরির ঠোঁটে বিষন্ন হাসি, ‘না খুড়ো, আর হবে না।’
প্রতিবাদ করে খুড়ো, ‘ ক্যান হইবে না হরি? চেয়াষ্টা কইরতে দোষ কোথায়?’
হরি বলে, ‘জলে যেন একটা নেশা ধরে খুড়ো, মারণ নেশা। ঘরে স্থির হয়ে থাকতে পারিনা, মনে হয় সারাক্ষণ জলে ভেসে থাকি। রাক্ষসী গঙ্গা যেন ডাকে খুড়ো।’
রহমত বলে, ‘ও কথা কইতে নাই বাপ, পাপ হবে যে।’
খুড়ো বলে, ‘না না পাপ হইবে ক্যান? ওইডা তো ওর অভিমানের কথা। তাইনা বাপ?’
হরি যেন হারিয়ে ফেলে নিজেকে। আপনমনে সে বলে চলে, ‘জানো খুড়ো, সেই কোন ছোটবেলা বাপের হাত ধরে নদীতে ভাসা শুরু করলাম। হাতে বৈঠা নিয়ে নদীর জল ঠেলতে ঠেলতে কবে যে কাবিল বনে গেলাম, নিজেই জানিনে।’ অফুরন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরি।
রহমত বলে ওঠে, ‘বাপ, তুমি যে আমার কথা বললা।’
খুড়ো বলল, ‘আমাগোর জেইলেগো জীবনডা যে এক সুতায় গাঁথা রহমত।’
হরি ফের স্মৃতি হাতড়ায়, ‘ জানো খুড়ো সেদিন আকাশে মেঘের দিকে তাকিয়ে বাপ আমায় বলল, আজ তোর গঙ্গায় গিয়ে কাজ নেই। আমরা দল বেঁধে যাব, তুই নদীর টান ঠাওর করতে পারবিনে। দলের সবাই ফিরে এল, বাপ ফিরল না।’ গলা ধরে আসে হরির। (পথে পরবাসে)