কোনও কারণে ভারত-বাংলাদেশ….

কোনও কারণে ভারত-বাংলাদেশ….

কোনও কারণে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বেনাপোল-পেট্রোপোলে যখন যাই (যেমন কিছুদিন আগেই গিয়েছিলাম ওপার বাংলা এপার বাংলার মিলিত উদ্যোগে “ভাষাদিবস উদযাপন”-এর দিনে) তখন না জানি কেন বেশ কয়েকবছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। আর হ্যাঁ, এটি কেবল আমার কল্পনার সুতোয় নিছক গল্প বুনন নয় –
ভোর সাতটা নাগাদ বাড়ি থেকে বের হন রেণুকাদেবী আর সীমা । মাসিকে একা ছাড়তে সাহস পায়নি সীমা। তাই মাসির সাথে সাথে সে-ও তার পাসপোর্ট দেখিয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার অফিস থেকে বাংলাদেশ যাবার জন্যে এক মাসের ভিসা বের করে । বেলা প্রায় দশটার সময় বৃদ্ধা রেণুকাদেবী এক হাতে পাসপোর্ট আর অন্য হাতে প্রিয়জনদের জন্য মিষ্টি ও ফলের প্যাকেট নিয়ে হাজির হন ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেট্রোপোল পেরিয়ে বেনাপোল । বেনাপোল বি.ডি.আর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ও পাড়ের যতদূর দৃষ্টি যায় তিনি যেন ততটাই দেখতে চেষ্টা করলেন । কেবলই তাঁর মনে হতে লাগল, এগারো বছর বয়সে ফেলে আসা তাঁর জন্মভিটা সাতপার যেন তাকে দু’হাত প্রসারিত করে ডেকেই চলেছে, “কি রে দাঁড়িয়ে কেন ? আয়, আয় না মা আমার কোলে ।“
“এই যে ম্যাডাম, দেখি আপনাদের পাসপোর্টগুলো”, এক বি.ডি.আর অফিসারের কন্ঠস্বর কানে আসে তাদের ।
“রেণুকাদেবী আর সীমা তাদের পাসপোর্ট দুটি দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল । মিনিট দশেক বাদে অফিসার ফিরে এসে পাসপোর্ট দুটি তাদের হাতে দিয়ে বলেন, “সরি ম্যাডাম, বাংলাদেশে আপনাদের যাওয়া হবে না ।“
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে রেণুকাদেবীর, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না তিনি, মাটিতে বসে পড়লেন । সীমা তার হাত ধরে বলে ওঠে, “মাসি, কি হয়েছে ?”
কোনও কথা বলতে পারলেন না রেণুকাদেবী, কেবলই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সীমার মুখের দিকে। সীমা অফিসারকে বলল,“কেন অফিসার ? কেন আমরা বাংলাদেশে যেতে পারব না ?”
“শুনুন ম্যাডাম, বর্তমানে ম্যানুয়াল পাসপোর্ট আমরা গ্রান্ট করছি না, এখন এম.আর.পি অর্থাৎ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ব্যবহৃত হচ্ছে ।“
“কিন্তু হাইকমিশন দপ্তর তো এই ম্যানুয়াল পাসপোর্ট দেখেই ভিসা দিয়েছে ।“
“শুনুন, উনারা যে কেন ভিসা দিলেন আমরা তা বুঝতে পারছি না । তবে ম্যানুয়াল পাসপোর্ট অনেকদিনই হল গ্রাহ্য নয় ।“
রেণুকাদেবী এবার কাতর স্বরে বলে ওঠেন, “শুনুন, আমার বয়স সত্তরের উপর, আমি ক্যানসারের রোগী, কেমো চলছে । একটিবার যেতে দাও না বাবা ।“
অফিসারকে নিরুত্তর দেখে তিনি পুনরায় বললেন, “বেশিদিন বাঁচব না, ডাক্তার বলেছে বড়োজোর ছ’মাস ; তার মধ্যে একমাস তো হয়েই গেল । একবার শুধু আমার জন্মভিটাটা –
“সরি ম্যাডাম,আমরা যে আইনে বাঁধা।“
“আইন, কোন আইনে আছে মা তার সন্তানকে আলাদা করতে তাদের মাঝখানে কাঁটাতারের ব্যবস্থা করতে হবে, বলতে পার বাবা ?” সজল চোখে তাকালেন জীবনসায়াহ্নে আসা সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা রেণুকাদেবী ।
সেই দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারলেন না বি.ডি.আর অফিসার, চোখ তাঁরও ছলছলিয়ে আসছে যে । তিনি চোখ নামিয়ে অধোবদনে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলেন ।
রেণুকাদেবী বুঝলেন, তাঁর সমস্ত চেষ্টা বুঝি ব্যর্থ হল, তিনি একমুঠো ধুলি নিজের আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, “মা গো, এ জন্মে যে আর দেখা হল না ।“ তারপর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ।