প্রতিদিনের মত আজও তাড়াহুড়ো করে ৮ : ১৫-এর বারাসাত লোকাল ধরলাম অফিস যাব বলে । কি ভাবছেন ? অফিস ! হ্যাঁ, লেখক হলেও আমি একজন পাবলিক সার্ভেন্ট । শিয়ালদহ নেমে চারিদিক একবার তাকালাম । না, আজও নেই সে । অগত্যা, একনম্বর গেটের কাছের চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম । “আরে ওই দ্যাখ, লোক ঠকানোর নিউ স্টাইল । থান কাপড় পড়ে ভিক্ষার চল উঠে গেছে, তাই লোকের সেন্টিমেন্টে ঘা মেরে থান কাপড় পড়ে চা বিক্রি করছে“, কথাটা কানে যেতেই দাঁড়ালাম । “না রে, বাচ্চাটার মুখটা কিন্তু ইনোসেন্ট”, দ্বিতীয় বন্ধুর কথা কানে আসতেই ওরা যাকে নির্দেশ করে কথাগুলো বলছিল সেদিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম, “বিট্টু ।“ পাশে সিমেন্টের বেঞ্চে চায়ের কেটলি রেখে সে দাঁড়িয়েছিল । “এই বিট্টু”, ডাক শুনে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে । কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’চোখে তার শ্রাবণ নেমে এলো। তার মাথায় হাত রাখতেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল । কি বলে সান্ত্বনা দেব তাকে ? কাঁদুক, মনটা হালকা হোক । হয়তো, মনের মানুষ কাউকে পাইনি বলে বেচারা মা হারানোর কান্নাটাও কাঁদতে পারেনি । পরে অবশ্য চোখ মুছতে মুছতে সে নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়াল ,“চারদিন হয়ে গেল ।” গলা ধরে আসে তার । বললাম, “কাঁদিস নে বিট্টু, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হতে হবে যে ।“
“সেজন্যেই আজ চা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । ওষুধ কিনতে হবে যে, ক’দিন ধরে বোনটারও জ্বর । ভেবেছিলাম, হাসপাতালে নিয়ে যাব । ও কেঁদে বলল, দাদা, হাসপাতালে ভয় করে । আসলে, মা হাসপাতালে মারা গেছে তো”, ফের চোখের জল মোছে বিট্টু । মনে মনে ভাবি, এটুকু বয়সে এত মমত্ববোধ আসে কোথা থেকে, এত দায়ভারই বা নেওয়ার শক্তি পাস কি করে বিট্টু ? তার মুখেই শুনেছিলাম, ছোটবেলায় বাপ মারা যাওয়ার পর মা যখন রোগে পড়ল, স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে রেখে সে রোজগার করতে নেমে পড়ে । কখনও চায়ের দোকানে কাপ, প্লেট, কেটলি ধুয়ে, কিংবা কেবল খাবার বিনিময়ে হোটেলের থালা, বাসন মেজে । তবে খাবার সে নিজে খেতো না, তার মা, বোনের জন্যে পলিপ্যাকে নিয়ে আসত । কতদিন তার কেবল জল খেয়েই পেট ভরাতে হয়েছে ।
সে ফের বলল,”কিন্তু অশুচ কাটেনি বলে মনে হয় কেউ আমার হাতে চা খাচ্ছে না কাকু । তাই তোমরা যারা রোজ চা খাও, তাদের খুঁজছি ।“
আমি বললাম, “চা বিক্রি করতে হবে না ।“ তারপর মানিব্যাগ বের করে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করে বললাম, “এটা রাখ ।“
বিট্টু কেমন যেন অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমরাও আমার চা খাবে না কাকু ?” কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কেটলি হাতে তুলে নিয়ে সে বলে, “যাই, তাহলে । ভেবেছিলাম, তোমরা আমার চা খেলে, তা দেখাদেখি অনেকেই খাবে ।“
বিট্টু চলে যায় দেখে আমি বললাম, “বিট্টু টাকাটা রাখ ।“
“না কাকু, মায়ের কাজ, ধার করে করব না”, যাবার জন্যে পা বাড়াতেই আমি বলে উঠি, “চা দিবি না ?“
আনন্দে সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে,”সত্যি কাকু, তুমি খাবে ?” তারপর কাগজের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে, “আমি ঠিক মায়ের কাজ করতে পারব । শুধু তো ঘাট, আর শ্রাদ্ধের কাজ, তারপর কয়েকজনকে খাওয়ানো, ঠিক হয়ে যাবে ।“
এক কাপ নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিন কাপ চা খেলাম । সময় বয়ে যায়, অফিসে যেতে হবে, বললাম, “কাল এখানে দাঁড়াবি আমরা সবাই তোর কাছে লাইন দিয়ে চা খাবো। আর শোন, এই টাকাটা রাখ, মায়ের কাজের জন্যে দিচ্ছি না, বোনের চিকিৎসার খরচ । নে ধর ।“
“মায়ের ওষুধ কিনতে এর আগেও তো অনেক দিয়েছ কাকু, ধরে রাখতে পারলাম না। অনেক দেনা হয়ে গেল । শোধ দিতে পারবো না যে । তার থেকে যা হয় হোক বোনটার । মায়ের মত সেও যদি ফাঁকি দেয়, কি করে ঠেকাবো কাকু ”, বছর তেরোর ছেলেটার কথা শুনে রাশি রাশি কান্না আসছে কোথা থেকে ? দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে যেন । বিট্টু দেখলে কি ভাববে ? যথাসম্ভব চোখের জল গোপন করে বলি, “মার খাবি বিট্টু, রাখ এটা । আর কাল কিন্তু এখানেই থাকবি”, বলেই টাকাটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে একপ্রকার ছুটে পালিয়ে এলাম তার সামনে থেকে ।