একজন কুইয়ার ব্যক্তি হিসেবে……..

একজন কুইয়ার ব্যক্তি হিসেবে……..

“একজন কুইয়ার ব্যক্তি হিসেবে, আমি ভালভাবেই বুঝতে পারি এই প্রতিকূল সমাজে টিকে থাকার জন্য নিজের একটা অংশ গোপন রাখার অনুভূতি কেমন”, উক্তিটি এক বিশ্বখ্যাত হলিউড তারকার । সাদা কালো যুগের এই অভিনেত্রী কেবল রূপ-লাবণ্যেই নয়, অভিনয়ের দক্ষতায় ছিলেন অদ্বিতীয়া । খ্যাতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছেও এক নিদারুণ স্বভিমান তুষের আগুনের মত ধিকধিক করে তাঁকে প্রতিক্ষণ দগ্ধ করত । এক অজানা আশঙ্কা, এক অজানা নিরাপত্তাহীনতা তাঁকে তাড়া করে ফিরত সর্বদা । কিংবদন্তি অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ার-এর বিপরীত চরিত্রে দাপুটে অভিনয়ে যিনি বিশ্ববরেণ্য হয়ে উঠেছিলেন, রুপালি পর্দায় যাকে দেখার জন্যে লাখো ভক্ত উৎসুক হয়ে থাকত, যার ভুবনমোহিনী রূপ তৎকালীন গোটা ইউরোপের ইয়াং জেনেরেশনকে স্বপ্নে বিভোর করে তুলেছিল, তিনি কেবলই ভাবতেন, একটামাত্র পরিচয় তাকে নক্ষত্রমন্ডল থেকে টেনেহিঁচড়ে নিমেষেই অন্ধকার, স্যাতসেতে এক গিরিখাতে এনে ফেলতে পারে ।
বাস্তবে, আমরা কোনও হিজড়ের হাততালি দেওয়া, কিংবা অঙ্গ দুলিয়ে সামান্য কয়েকটা দুষ্টু-মিষ্টি কথার অভিনয় দেখে অভ্যস্থ । খুব বেশি হলে কোনও ভিলেনের চরিত্রে দেখতে পাই হয়তো । কিন্তু, দ্য ডার্ক অ্যাঞ্জেল-এ অভিনয়ে যে সুন্দরী নায়িকা তার অভিনয়ের উৎকর্ষতা এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন যার জন্য অস্কারের মনোনয়নে তাঁর নাম উঠে এলো । ১৯৩৫ সালে ক্লাসিক চলচ্চিত্র ওয়াদারিং হাইটসের চরিত্রে কাজ করে সুপরিচিত হন তিনি ।
তিনি যে এক থার্ডজেন্ডার তা শোনার পর হয়তো স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে তাঁর ভক্তদের – এই আশঙ্কায় তিনি তার একটা অংশ লুকাতে সদা ব্যস্ত থাকতেন । সমাজ, জাতি, দেশ, এমনকি গোটা পৃথিবীর উপর একরাশ অভিমান বুকে চেপে তিনি তার নিখুঁত অভিনয়ে সমৃদ্ধ করে গেছেন “দ্য প্রাইভেট লাইফ অফ হেনরি ৮”, “দ্য লুজার, “টিল উই মিট এগেইন”, “এ ওয়ার্ম কর্ণার”, “দ্য ডিভোর্স অফ লেডি”, “দ্য কাউবয় অ্যান্ড দ্য লেডি”, “এ সং টু রিমেম্বর”, “বার্লিন এক্সপ্রেস”, “ডীপ ইন মাই হার্ট”, “বিলাভড এনিমি”-এর মত আরও অগণিত চলচ্চিত্র ।
হ্যাঁ, তাঁর নাম মার্লে ওবেরন । এদেশেই তার জন্ম । অথচ, নিজ জন্মভূমিতেই তিনি এক বিস্মৃত আইকন । প্রতিকূল সমাজের বিষাক্ত দন্ত, নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় নিজের আসল জন্ম-পরিচয় সবসময় গোপন রেখেছেন তিনি । আসলে, তিনি ছিলেন একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান । ১৯১১ সালে বোম্বেতে(বর্ত্মান মুম্বাই) জন্ম, মা ছিলেন অর্ধেক সিংহলি ও অর্ধেক মাওরি, বাবা ব্রিটিশ । ১৯১৪ সালে ওবেরনের বাবা মারা যাবার পর ১৯১৭ সালে পুরো পরিবার কলকাতায় চলে আসেন । তবে তিনি আজীবন নিজেকে একজন শ্বেতাঙ্গ হিসাবেই পরিচয় দিয়ে গেছেন । তাসমানিয়াকেই নিজের বাড়ি বলে পরিচয় দিতেন ।
কলকাতার নাম তিনি কদাচিৎ উল্লেখ করেছেন । হয়তবা নিজের আসল পরিচয় গোপন করতেই এমনটি করতে হয়েছে তাঁকে । তবে কলকাতা তাঁকে মনে রেখেছে । “১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর দিকে অনেক ইংরেজের স্মৃতিকথায় তার উল্লেখ আছে”, বলেছেন সাংবাদিক সুনন্দ কে দত্ত । অভিশপ্ত জীবনের গ্লানি থেকে নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে কতটা লড়াই তাঁকে করতে হয়েছে তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু বুঝতে পারি, লিঙ্গবৈষম্যের নিরিখে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি এ সমাজের প্রতিকূল, কুটিল অবস্থানে নিজেকে হারিয়ে ফেলার একটা ভয় সর্বদা তাঁকে তাড়া করে ফিরত । আমি সত্যিই জানি না, এ অত্যাধুনিক যুগে শিক্ষিত তৃতীয় লিঙ্গের কতজনা সে ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে ।